সোনারগাঁ বাংলাদেশের ইতিহাসের এক গৌরবোজ্জল প্রাচীন জনপদ। সোনারগাঁ জাতির ইতিহাস, সংস্কৃতি ও শিল্পকলার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। প্রাচীন বাংলার রাজধানী সোনারগাঁর একাংশে রয়েছে পানাম নগর। পানাম নগর বাংলাদেশের ঢাকা বিভাগের নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁ উপজেলায় অবস্থিত। ঢাকা থেকে দক্ষিণ-পূর্বে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরত্বে পানাম সিটি অবস্থিত। বর্তমানে পর্যটনের নগরী হিসেবে রূপান্তরিত হয়েছে। এখনে প্রতিদিন দেশ-বিদেশের হাজারো পযর্টক ঘুরতে আসেন। পানাম নগরকে সরকার ২০০৩ সালে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে গেজেটভুক্ত করে ২০১৫ সালে ৬ অক্টোবর পর্যটকদের জন্য উম্মুক্ত করে দেয়।
জানা গেছে, সোনারগাঁ ছিল বাংলার মুসলিম শাসকদের অধীন পূর্ববঙ্গের একটি প্রশাসনিক কেন্দ্র।তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে সোনারগাঁ ছিল বাংলার মুসলিম শাসকদের রাজধানী। এখানে রয়েছে গ্রাম বাংলার ঐতিহাসিক নানান সব নিদর্শন।এখনো পানাম নগরে দেখা যায় অপূর্ব ও নিপুণ কারুকাজখচিত প্রাচীন সব ইমারত। সরু রাস্তার দুই পাশে অট্টালিকা, সরাইখানা, মসজিদ, মন্দির, মঠ, ঠাকুর ঘর, গোসলখানা, কূপ, নাচঘর, খাজাঞ্চিখানা, টাঁকশাল, দরবার কক্ষ, গুপ্তপথ, প্রশস্ত দেয়াল, প্রমোদালয় জানান দেয় এ নগরের প্রাচীন সমৃদ্ধির কথা।পানাম নগরের বিভাশিত বর্নাঢ্য-ইমারত সমূহ স্বাক্ষ্য দেয় একসময় সোনারগাঁয়ের অভিজাত নাগরিকদের বসবাসের কেন্দ্র ছিল। ১২৮১ খ্রিষ্টাব্দে এই অঞ্চলে মুসলিম আধিপত্যের সূচনার পর আওরঙ্গজেবের আমলে বাংলার রাজধানী ঢাকা ঘোষণা হওয়ার আগপর্যন্ত মুসলিম সুলতানদের রাজধানী ছিল সোনারগাঁও। যদিও তখন প্রাচীন এই রাজধানী পানাম নামেই পরিচিত ছিল। ঈশা খাঁ ও তার বংশধরদের শাসনামলে সোনারগাঁ ছিল পূর্ববঙ্গের রাজধানী।
সরেজমিনে দেখা গেছে,কোনো রকম টিকে আছে ঈশা খাঁর শাসনামলে গড়ে ওঠা ঐতিহাসিক পানাম নগর।পানাম নগরের প্রত্যেকটি ভবন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ।পানাম নগর হারাতে বসেছে তার ঐতিহাসিক রূপ, সোন্দর্য ও জৌলুস। এই নগরের অনেক প্রাচীন স্থাপনাই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ২০ বর্গকিলোমিটার এলাকার এ শহরের মাঝে দিয়ে চলে যাওয়া সড়কের দুই পাশে ছোট-বড় ১০২টি ইমারত একসময় শোভা পেলেও বর্তমানে কোনো রকম টিকে আছে মাত্র ৫২টি ভবন।পানাম সিটির মাঝে দিয়ে যে সড়কটি রয়েছে, তার একপাশে ৩১টি আর অপর পাশে ২১টি ভবন রয়েছে। এখন পর্যন্ত সংস্কার করা হয়েছে মাত্র দুটি (৪ নম্বর ও ১৩ নম্বর) ভবন।
এক সময়কার ঐশ্বর্যমণ্ডিত আজকের জীর্ণ-পরিত্যক্ত পানাম নগরী তার অন্যতম স্মৃতি স্মারক। সোনারগাঁয়ে আকাশে-বাতাসে, জরাজীর্ণ প্রতিটি অট্টালিকার ইটের পরতে পরতে আজও যেন ধ্বনিত স্পন্দিত হয় বাংলার গৌরবময় রোমাঞ্চকর ইতিহাসের চাপা দীর্ঘশ্বাস।পানাম নগর একসময় সন্ধ্যা নামার পর নাচ, গান, সুর ও সাকির আয়োজনে মেতে উঠত; নৃত্যের তালে তালে ঝুমুরের শব্দ ও তানপুরার সুরে মুখর হয়ে উঠত সোনারগাঁর বাতাস। আজ সেই নগরে সন্ধ্যা নামলে নেমে আসে গা-ছমছমে নীরবতা।যে নাচঘরে সারা রাত চলত জলসা, নর্তকীর পায়ের ঘুঙুরের শব্দে মুখরিত থাকত; সেই নাচঘর এখন আর আলোকিত হয় না। নামিদামি বণিক ও পর্যটকদের ডিঙি নৌকা ভেড়ে না নগরের ময়ূরপঙ্খি ঘাটে। এখন যেন পানাম নগরের দেয়ালে কান পাতলে শোনা যায় নগরের হাহাকার আর আর্তনাদ।
স্থানীয় ইতিহাসবিদ, লেখক ও বয়োজ্যেষ্ঠদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৭৭-৭৮ সালের দিকেও পানাম নগরীর রাস্তার দুই পাশে প্রাচীনকালের প্রায় একই আদলে তৈরি একতলা ও দ্বিতলবিশিষ্ট ১০২টি ইমারত ছিল। ১৯৭৭-৭৮ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বছরের বিভিন্ন সময় প্রায় অর্ধেক ভবন ধ্বংস হয়। ধসে যাওয়া ভবনগুলোর বেশির ভাগই ধ্বংস করা হয়েছে ব্যক্তিগত লোভ-লালসার কারণে। আর কিছু ধ্বংস হয় প্রকৃতগতভাবে বা রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে।
ঐতিহাসিকদের মতে, প্রাচীন সুবর্ণ গ্রাম থেকে সোনারগাঁ নামের উদ্ভব। ১৩ শতকের স্থানীয় হিন্দু রাজা দনুজ মাধব দশরথদেব সুবর্ণ গ্রামকে তাঁর শাসনকেন্দ্রে পরিণত করেন। বঙ্গ অঞ্চল মুসলিম শাসনে আসার পর থেকে ঢাকা সুবা বাংলার রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগপর্যন্ত সোনারগাঁ ছিল স্বাধীন সুলতানি বাংলার অন্যতম রাজধানী ও প্রশাসনকেন্দ্র। হাজার বছরের প্রাচীন। শহর সোনারগাঁ কেমন ছিল, তা আর আজ জানা যায় না। সেই অজানা নগরের কথা বলতেই যেন সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পানাম নগর। স্থানীয় লোকজনের কাছে যা 'মৃত নগরী' বা 'রহস্য নগরী'।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সূত্রমতে পানাম নগরের স্থাপনাগুলোয় ইউরোপীয় স্থাপত্যরীতির সঙ্গে মোগল ও সুলতানি স্থাপত্যরীতির মিশ্রণ রয়েছে। নিখুঁত নকশায় গড়া একটি সমৃদ্ধ নগর ছিল পানাম। এর সঠিক বয়স জানা যায় না। তবে ধারণা করা যায় যে শত শত বছর ধরে পানাম মূলত সমৃদ্ধ ব্যবসানগরী হিসেবে গড়ে উঠেছিল। ঐতিহ্যের মসলিন ও পরবর্তীকালে নীল কেনাবেচার কেন্দ্র হিসেবে এই নগরকে ব্যবহার করা হয়েছে।
ঐতিহ্যমণ্ডিত এবং ঐতিহাসিক এই স্থাপনাগুলো অনতিবিলম্বে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে সচেতন সুধীমহল মনে করেন। সেই সঙ্গে এই পুরাকীর্তিগুলো তার পুরোনো কাঠামো এবং আদলেই সংস্কার ও সংরক্ষণ করা একান্ত প্রয়োজন, নয়তো যে কয়েকটি স্থাপনা এখনো অবশিষ্ট আছে, একসময় তার শেষ চিহ্নটুকুও কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। সেই সঙ্গে হারিয়ে যাবে এক ঐতিহ্যবাহী সমৃদ্ধ নগরীর গর্বিত ইতিহাস।
এইচএ