সিরাজগঞ্জের বেলকুচিতে দুই যুগেরও বেশি সময়েও চালু হয়নি তামাই পানি শোধনাগারটি (ইটিপি প্লান্ট)। যে কারণে তাঁত শিল্পসমৃদ্ধ উপজেলার তামাই গ্রামে নির্মিত এই ইটিপি প্লান্টটির বেশির ভাগ যন্ত্রপাতি তদারকির অভাবে নষ্ট হয়ে গেছে।, চুরি হয়ে গেছে বিদ্যুতের ট্রান্সফরমার ও সবগুলো বৈদ্যুতিক মটর।পানি শোধনাগার না থাকায় এই গ্রামের তাঁতশিল্পে সুতা রঙের কাজে ব্যবহৃত ক্যামিক্যাল মিশ্রিত পানি শোধন ছাড়াই যত্রতত্র খাল, বিল ও ডোবা, নালায় ফেলা হচ্ছে। ফলে ক্যামিক্যাল মিশ্রিত পানি মাটির স্তরের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ সুপেয় পানির সঙ্গে মিশে যাওয়ায় স্থানীয়রা নানারকম রোগে ভুগছেন।
পরিবেশ অধিদপ্তর ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৭ সালে পরিবেশ অধিদপ্তরের ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়েস্ট ম্যানেজম্যান্ট প্রকল্পের আওতায় প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে পানি শোধনাগারটি (ইটিপি প্লান্ট) নির্মাণ শুরু হয়। সে সময় এই প্রকল্পটি মন্ত্রীসভায় অনুমোদনও দেওয়া হয়। যথা সময়ে প্লান্টির নির্মাণ কাজ শুরু করা হলেও সম্পূর্ণ কাজ শেষ করে স্বচল না করেই ফেলে রাখা হয় এই প্লান্টটি।
ইটিপি প্লানটির উদ্যোক্তা তামাই গ্রামের আবদুল লতিফ বাদল বলেন, কোন চক্রান্তের কারণে আমাদের এই প্লান্টটি নির্মাণের শেষ পর্যায়ে বন্ধ হয়ে আছে, তা আমরা কিছুই জানি না। এ বিষয়টি তদন্ত করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তিনি।
তামাই গ্রামের ব্যবসায়ী ফজলার রহমান বলেন, অনেক আশা করে কিছু জমিও আমরা দিয়েছি যাতে ইটিপি প্লান্টটি চালু হয়। কিন্তু দুই যুগেরও বেশি সময়েও এটি চালু হলো না। প্লান্টটি এলাকার মানুষের জন্য খুবই প্রয়োজন।
তামাই হ্যান্ডলুম ও পাওয়ারলুম এসোসিয়েশন সূত্রে জানা গেছে, শুধু মাত্র এই তামাই গ্রামেই প্রায় ১৫ হাজার শক্তি চালিত তাঁত (পাওয়ারলুম) রয়েছে। ছোট ,বড় ও মাঝারি আকারের সুতা রঙের কারখানা রয়েছে প্রায় ৩৫টি। সুতা প্রক্রিয়া করণ কারখানা রয়েছে ৫টি।
বেলকুচি উপজেলায় তাঁত শিল্পসমৃদ্ধ তামাই গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, তামাই পানি শোধনাগারটির (ইটিপি প্লান্ট) জন্য নির্মিত পানির ট্যাংকসহ আনুষঙ্গিক উপকরণ ও যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। চুরি হয়ে গেছে বিদ্যুতের ট্রান্সফরমার ও সবগুলো বৈদ্যুতিক মটর। স্থানীয় তাঁতশিল্পের কাঁচামাল সুতা রংসহ বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক বর্জ্য মিশ্রিত পানি এই সব কারখানা গুলো থেকে প্রতিনিয়ত ফেলা হচ্ছে খাল, বিল, ডোবা ও নালায় । এ পানি আবার মাটির গভীরে গিয়ে মাটির ভূগর্ভস্থ সুপেয় পানির স্তরে মিশে সেটি আবার ওঠে আসছে নলকূপগুলোতে। শোধন ছাড়াই এসব দূষিত পানি পান করে চর্ম, পেটের পীড়াসহ নানারকম রোগে ভুগছেন এলাকাবাসী।
বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় বাধ্য হয়েই এলাকার মানুষকে দূষিত পানি ব্যবহার করতে হচ্ছে। সেইসঙ্গে গ্রামটির পুকুর গুলোতে জমে থাকা এই বর্জ্যমিশ্রিত পানি একটু বৃষ্টি হলে স্থানীয় সূতা প্রক্রিয়াকরণ কারখানার মালিকেরা কেটে দেয়। তখন এই পানি আবার যায় স্থানীয় হুড়া সাগর নদীতে। এ কারণে এই নদীও হারাতে বসেছে তার প্রাণবৈচিত্র।
তাঁত শিল্পসমৃদ্ধ এই এলাকার মানুষের সমস্যা সমাধানের জন্যই প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হলেও কোনও কারণে এটি বন্ধ হয়ে রয়েছে জানে না স্থানীয়রা।
তামাই দক্ষিণ পাড়া মহল্লার গৃহিনী মরিয়ম পারভীন বলেন, তাদের বাড়ির চারপাশের পুকুরে বর্জ্যমিশ্রিত পানি থাকার কারণে সেখানে কোনও মাছ নেই। সেইসঙ্গে তার বাড়ির দুটি নলকূপের মধ্যে একটিতে বর্জ্যমিশ্রিত পানি বের হয়। তবুও বাধ্য হয়ে সেই পানিই তাদের খেতে হচ্ছে।
তামাই উত্তর পাড়া মহল্লার তাঁত ব্যবসায়ী হাসান আলী বলেন, আমরা বড় আশায় ছিলাম প্লান্টটি হলে ভালো পানি খাইতে পারবো কিন্তু তা আর হলো না।
কাজীপুরা সবুজপাড়া গ্রামের ব্যবসায়ী জুয়েল আহমেদ বলেন, মাঝে মধ্যে সুতা প্রক্রিয়াকরণ কারখানার বর্জ্যমিশ্রিত পানি কারখানার মালিকরা ছেড়ে দেয় নদীতে। তখন হুড়া সাগর নদীতে অনেক দেশি মাছের মৃত্যু হয়। আমরা স্থানীয়রা নিষেধ করলেও বিষয়টি কারখানা মালিকেরা শোনেন না । বিষয়টি স্থানীয় পরিবেশ অধিদপ্তরের একাধিক বার জানিয়েও কোন লাভ হয়নি।
ওই গ্রামের জনতা কালার ডাইং নামের সুতা রঙের কারখানার স্বত্বাধিকারী হাবিবুল্লাহ প্রামাণিক বলেন, আমরাও সুতা রঙের কাজে ব্যবহৃত ক্যামিক্যাল মিশ্রিত পানি শোধন ছাড়াই যত্রতত্র ফেলতে চাই না। এককভাবে একটি ইটিপি প্লান্ট নির্মাণ করার মতো অর্থনৈতিক অবস্থা আমাদের নেই। যে কারণে আমরা অনেক আশা করেছিলাম পরিবেশ অধিদপ্তরের মাধ্যমে নির্মিত ইটিপি প্লান্টটি চালু হবে। কিন্তু দীর্ঘ দিনেও সেটি চালু হচ্ছে না।
পরিবেশ অধিদপ্তরের সিরাজগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আবদুল গোফুর জানান, জনবল স্বল্পতার কারণে কী কারণে ইটিপি প্লান্টটি এখনও চালু করা সম্ভব হয়নি তা উদঘাটন করতে পারিনি। তবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এইচএ