কৃষি শিক্ষা ও গবেষণার প্রাণকেন্দ্র বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় । কৃষি প্রধান বাংলাদেশে টেকসই কৃষি উন্নয়নে বাকৃবির গবেষকরা প্রতিনিয়ত নানা ধরণের গবেষণা পরিচালনা করছেন। এ বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্লেখযোগ্য কিছু গবেষণার সাফল্য হলো:
শিং মাছের জিনোম সিকোয়েন্স উদ্ভাবন
শিং মাছের জিনোম সিকোয়েন্স গবেষণার মাধ্যমে মাছটির জিনসমূহ কীভাবে বিন্যস্ত আছে তা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই গবেষণার মাধ্যমে শিং মাছের দৈহিক বৈশিষ্ট্য ও লিঙ্গ নির্ধারণ সহজতর হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, স্ত্রী শিং মাছের বৃদ্ধি পুরুষ শিং মাছের তুলনায় ৪০-৬০ শতাংশ বেশি। মনোসেক্স স্ত্রী শিং মাছ উৎপাদনের লক্ষ্যে এই গবেষণা পরিচালিত হয়। এই গবেষণার নেতৃত্ব দিয়েছেন ফিশারিজ বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিক্স বিভাগের অধ্যাপক ড. তাসলিমা খানম। সহকারী গবেষক হিসেবে ছিলেন একই বিভাগের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীরা: নিত্যনন্দ, স্বণা, জেসমিন, কানিজ, এবং সারা।
বাউ মিষ্টি আলু-৫
কৌলিতত্ত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের অধ্যাপক ড. এ.বি.এম. আরিফ হাসান খান রবিন উদ্ভাবিত নতুন জাত "বাউ মিষ্টি আলু-৫" । প্রতি গাছে ৪-৬টি কন্দ উৎপন্ন হতে পারে। প্রতিটি কন্দের গড় ওজন ২০০-৩০০ গ্রাম। এই জাত ৯০ থেকে ১০০ দিনে উৎপাদনে আসে। গবেষণায় দেখা যায় এটি প্রচলিত মিষ্টি আলু জাতের চেয়ে দ্বিগুণ ফলন দেয়। ফলে লাভও দ্বিগুণ। প্রতি ১০০ গ্রাম কন্দে রয়েছে ৭.৮ গ্রাম গ্লুকোজ , ০.১৫ মিলিগ্রাম ক্যারোটিনয়েড, ৩.৯ মিলিগ্রাম অ্যান্থোসায়ানিন, ১৫ মিলিগ্রাম ফ্যানোলিক। এছাড়াও এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ , বি, সি, কে, অ্যান্টিঅক্সিডেন্টও, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ফসফরাস, আয়রন, এবং জিঙ্ক বিদ্যমান। এতে অ্যান্থোসায়ানিন ও ক্যান্সার প্রতিরোধী উপাদানও বিদ্যমান। গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম হওয়ায় এটি ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য উপযোগী।
নারিকেলের সাদামাছির নতুন প্রজাতি শনাক্ত
এই প্রজাতির সাদামাছি আকারে ছোট। লম্বায় ১.১ থেকে ১.২ মিলিমিটার। যা নারিকেলের পরিচিত সাদা মাছির অর্ধেক হলেও প্রজনন ক্ষমতা এবং জলবায়ু সহনশীলতা দ্বিগুণ। এই মাছির সামনের ডানায় আড়াআড়ি চিহ্নযুক্ত ধূসর বর্ণের ব্যান্ড রয়েছে। অন্য সাদা মাছি যেখানে সুতাকার আকারে ডিম পাড়ে, সেখানে এটি মোম ও তুলা দিয়ে পাখির মতো বাসা তৈরি করে ডিম পাড়ে। এদের ডিমে পাতার বোটার মতো অংশ থাকে যা অন্য সাদামাছিতে দেখা যায় না। এদের পিউপেরিয়াম সমতল এবং কোনো লেজের মতো বর্ধিত অংশ থাকে না। এই নতুন প্রজাতির সাদা মাছির বৈজ্ঞানিক নাম হল— প্যারালেইরোডেস বোন্দারি এবং বাংলায় বলা হয় বোন্দার নেস্টিং সাদামাছি। এই প্রজাতি শনাক্ত করেন কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. গোপাল দাস এবং স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী মো. সোহেল রানা।
আমিষে ছাগলের দ্বিগুন বৃদ্ধি
এই গবেষণার ৬৩টি ব্ল্যাক বেঙ্গল মা ছাগলকে ৯টি দলে বিভক্ত করা হয়। তিনটি ভিন্ন মাত্রার বিপাকীয় শক্তি (নিম্ন, মাঝারি, উচ্চ: যথাক্রমে ৮.৬৭, ১০.৪, ১১.৭৩ মেগাজুল/কেজি ড্রাই ম্যাটার) এবং তিনটি ভিন্ন মাত্রার আমিষ (নিম্ন, মাঝারি, উচ্চ: যথাক্রমে ১০%, ১৪%, ১৮%) সরবরাহ করা হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, উচ্চ মাত্রার শক্তি ও আমিষযুক্ত খাদ্য সরবরাহ করা হলে বাচ্চার জন্মের সময় ওজন, দৈহিক বৃদ্ধি হার অন্যান্য দলের চেয়ে বেশি এবং মৃত্যুহার কম। এছাড়াও এই খাদ্য মায়ের দুধ উৎপাদন, রক্তের বিপাকীয় উপাদান (রক্তরসের শর্করা, আমিষ, অ্যালবুমিন ও গ্লোবুলিন), ল্যাকটেশন সময় এবং পুনঃপ্রজনন ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করে। অন্যদিকে নিম্ন মাত্রার শক্তি ও আমিষ গ্রহণকারী দলের বাচ্চাদের পেশী তন্তুর ঘনত্ব এবং মায়োস্ট্যাটিন জিনের অভিব্যক্তি উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি দেখা গেছে। এর নেতৃত্ব দেন অ্যানিমেল সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড মনিরুজ্জামান।
বাকৃবি উদ্ভাবিত সংকর ছাগল
বোয়ার জাতের পাঠার সঙ্গে দেশীয় ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগীর সংকরায়নের মাধ্যমে একটি নতুন জাত উদ্ভাবন করা হয়। নতুন এই সংকর জাত ব্ল্যাক বেঙ্গলের সমপরিমাণ খাবারে দ্বিগুণ মাংস উৎপাদনে সক্ষম। পুরুষ ছাগল বছরে ২৬ কেজি এবং মাদি ছাগল ২৩ কেজি মাংস উৎপাদন করতে পারে। এ জাতটি রোগ প্রতিরোধী এবং ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের মতোই সহজে পালনযোগ্য। বাচ্চার জন্মের সময় গড় ওজন প্রায় ২ কেজি, যেখানে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের বাচ্চার গড় ওজন মাত্র ৮০০ গ্রাম। নতুন জাতের ছাগল দেখতে অত্যন্ত আকর্ষণীয়, কারণ এর চামড়ার রঙ সাদা-কালো। বাকৃবির পশুপালন অনুষদের পশু প্রজনন ও কৌলিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. রুহুল আমিন এবং স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী খালিদ সাইফুল্লাহ এই জাতটি উদ্ভাবন করেন।
আমের মিষ্টতা জানাবে ই-নোজ
আম না খেয়েও মিষ্টতা নির্ণয় করা যাবে ইলেকট্রনিক নোজ (ই-নোজ) প্রযুক্তির সাহায্যে। এর উদ্ভাবক কৃষি শক্তি ও যন্ত্র বিভাগের অধ্যাপক ড. আনিসুর রহমান। এই যন্ত্রটিতে দুটি চেম্বার রয়েছে। একটি আর্ডিউনো এবং আরেকটি রাস্পবেরি পাই ৪-এর সমন্বয়ে তৈরি। এতে স্বল্পমূল্যের এমকিউ সেন্সর, ১২ ভোল্টের ব্যাটারি, এবং একটি ব্লোয়ার ফ্যান ব্যবহৃত হয়েছে। মিষ্টতা নির্ণয়ের জন্য একটি চেম্বারে আম রেখে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করা হয়। আম থেকে নির্গত ঘ্রাণ সংবলিত গ্যাস পাইপের মাধ্যমে অন্য চেম্বারে যায়। সেন্সর তথ্য সংগ্রহের পর গ্যাসটি ব্লোয়ার ফ্যানের মাধ্যমে বাইরে বের করে দেওয়া হয়। সেন্সরের বিশ্লেষিত তথ্য দিয়ে আমের মিষ্টতা নির্ধারণ করা হয় । গাছ থেকে সংগ্রহের পর আম কতদিনে পেকে যাবে বা নষ্ট হবে, তাও জানা যাবে।
আমের আঁটির অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল
বিশ্বজুড়ে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সের কারণে প্রতিবছর লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু হয়। এ সমস্যা মোকাবিলায় প্রাকৃতিক উৎস থেকে অ্যান্টিবায়োটিকের বিকল্প খুঁজে বের করা জরুরি। মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড হাইজিন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. গোলজার হোসেন পরিত্যক্ত আমের আঁটির নির্যাস থেকে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ প্রতিরোধী একটি অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল উদ্ভাবন করেছেন। এটি ব্যাকটেরিয়ার কোষ এবং বায়োফিল্ম ধ্বংস করতে সক্ষম। প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিকের তুলনায় এটি নিরাপদ, সুবিধাজনক এবং সাশ্রয়ী। গবেষণা ২০২৩ সালে শুরু হয় এবং বর্তমানে এটি পোলট্রির ক্ষেত্রে কার্যকারিতা নিয়ে উচ্চতর গবেষণা চলছে।
আলু বাছাই যন্ত্র
সঠিকভাবে আলু বাছাই করতে না পারায় অল্প সময়ে আলু পঁচে যায়। ফলে প্রতিবছর বিপুল অর্থ লোকসান হয়। নতুন উদ্ভাবিত এই যন্ত্রটি আকার, রং এবং ত্রুটি অনুযায়ী আলু বাছাই করতে সক্ষম, যা সময় এবং খরচ সাশ্রয় করবে। যন্ত্রটি প্রতি ঘণ্টায় ৩০-৩৫ কেজি আলু বাছাই করতে পারে এবং এর সফলতার হার প্রায় ৮৬%। মোটরচালিত ৭ ফুট দীর্ঘ ও দেড় ফুট প্রস্থের কনভেয়ার বেল্ট (আলু পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত বেল্ট), ছবি বিশ্লেষণের জন্য কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত ক্যামেরা রয়েছে। এছাড়াও এটি এলইডি লাইটিং সিস্টেম, এবং সার্ভো মোটরের সমন্বয়ে এটি কাজ করে। এটি ম্যাটল্যাব প্রযুক্তি ব্যবহার করে আলুর আকার নির্ধারণ করে এবং পূর্বনির্ধারিত আকারের সঙ্গে তুলনা করে। এই যন্ত্রটির নাম দেওয়া হয়েছে "অটোমেটেড রিয়েল-টাইম পটেটো গ্রেডিং মেশিন"। এর উদ্ভাবক কৃষি শক্তি ও যন্ত্র বিভাগের অধ্যাপক ড. আনিসুর রহমান।
অভিযোজিত ফসল উদ্ভাবনে পলি হাউস
জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে উদ্ভাবিত হয়েছে পলি হাউস। এটি একটি নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ যেখানে তাপমাত্রা, লবণাক্ততা, আর্দ্রতা, এবং পানির উপর বিভিন্ন ফসলের প্রভাব বিশ্লেষণ করা হয়। অধ্যাপক ড. এ. বি. এম আরিফ হাসান খান রবিন উদ্ভাবিত এই পলি হাউসে আটটি সাধারণ চেম্বার, একটি কোল্ড চেম্বার, এবং একটি হিট চেম্বার রয়েছে। এখানে টমেটো, ভুট্টা, এবং ধানসহ বিভিন্ন ফসলের তাপমাত্রা ও লবণাক্ততা সহিষ্ণু জাত উদ্ভাবনের জন্য গবেষণা চলছে। ভবিষ্যতে হাইড্রোপোনিক পদ্ধতিতে ফসল ও শাকসবজি উৎপাদনের পরিকল্পনাও রয়েছে।
গর্ভপাত রোধে ব্রুসেলোসিস ভ্যাকসিন
ব্রুসেলোসিস হলো ব্রুসেলা ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট একটি রোগ, যা গবাদিপশুর ৬ মাসের পর গর্ভপাত ঘটায়। এটি খামারিদের আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি দুধ উৎপাদন কমিয়ে দেয়। দেশের প্রায় ৫-৬ শতাংশ গবাদিপশু এ রোগে আক্রান্ত। এই রোগটি জুনোটিক বা প্রাণী থেকে মানুষে সংক্রামক হওয়ায় প্রজনন ক্ষমতা ও কর্মক্ষমতা হ্রাস, তরঙ্গায়িত জ্বর, অন্ডকোষে প্রদাহ এবং নারীর গর্ভপাতও ঘটায়। পশু চিকিৎসক এবং খামারিরা এ রোগে বেশি আক্রান্ত হন। এর সমাধানে মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আরিফুল ইসলাম একটি ব্রুসেলোসিস ভ্যাকসিন উদ্ভাবন করেছেন। এটি মৃত ভ্যাকসিন হওয়ায় সংক্রমণের কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। প্রতি ছয় মাস অন্তর বুস্টার ডোজ দিতে হবে। বর্তমানে এটি গবাদিপশুর মধ্যে ব্যাপক কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে।
মুরগীর হিট স্ট্রেস কমাবে আমলকি
তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে ব্রয়লার মুরগী হিট স্ট্রেসে খাবার গ্রহণের পরিমাণ কমিয়ে দেয়। ফলে মাংস উৎপাদন কম এবং পেশিতে চর্বি জমা হতে শুরু করে। এমনকি মুরগির মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। খাবারের অতিরিক্ত হিসাবে আমলকি পাউডার ব্যবহার করে হিটস্ট্রেস থেকে মুক্তির সফলতা পেয়েছেন প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. চয়ন গোস্বামী। জানা যায় আমলকী ফলে অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টিস্ট্রেস ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এবং প্রচুর ভিটামিন সি রয়েছে। যা মুখের রুচি বাড়ানো এবং দেহে ফ্রি রেডিক্যাল মাত্রা হ্রাস করে। এছাড়াও পাকস্থলী ও ক্ষুদ্রান্ত্রে উপকারী ল্যাকটোব্যাসিলি ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয় এবং ই-কোলাই, সালমোনেলার মতো গ্রাম নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়াগুলো ধ্বংস করে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার এ সাফল্যগুলো টেকসই কৃষি উন্নয়ন এবং গ্রামীণ অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে।
এআই