রাতের বেলা শিশুরা ঘুমাতে না চাইলে অভিভাবকরা ভয় দেখান তার নাম ধরে। বৃদ্ধরা দোয়া পড়েন যেন তার সঙ্গে দেখা না হয়। আর তরুণরা আতঙ্কে থাকেন, কখনো যেন কোনো কারণে তার চক্ষুশূল না হয়ে পড়েন। কক্সবাজারের রামুর দক্ষিণ মিঠাছড়ির উমখালী এলাকায় দিদার বলীর পাপের সাম্রাজ্য এতটাই বিস্তৃত যে, শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার কাছে তিনি ‘মূর্তিমান আতঙ্ক’ হিসেবে একনামে পরিচিত।
বলি খেলে এক সময় চট্টগ্রাম দক্ষিণ অঞ্চলে খ্যাতি অর্জন করলেও সম্প্রতি ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে ‘মূর্তিমান আতঙ্ক’ হয়ে উঠেছেন এলাকাবাসীর কাছে। দীর্ঘদিন ধরে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে তার পুরো পরিবার এখন এলাকাবাসীর মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স্থানীয়দের দাবি, এক সময়ের জনপ্রিয় দিদার বলী এখন ‘ভয়ঙ্কর’ এক চরিত্রের নাম। রামুর দক্ষিণ মিঠাছড়িসহ উমখালী এলাকায় যত অপকর্ম হয় সবকিছুর মাস্টারমাইন্ড দিদার বলী। ক্ষমতা এবং দলীয় প্রভাবের ভয়ে এতদিন কেউ মুখ খোলার সাহস না পেলেও এখন ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে তার অপকর্মের নানা ফিরিস্তি।
অভিযোগ আছে, যখন যে সরকার থাকে সেই সরকারের লোকজনের ছত্রছায়ায় এলাকায় গড়ে তোলেন ত্রাসের রাজত্ব। পারিবারিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে মাদক, চোরাচালান, জমি দখল, মাটি কাটা, বালু উত্তোলনসহ নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি। দিদার বলী ওই ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ডের গণি সওদাগর পাড়ার আশরাফ আলীর ছেলে।
স্থানীয়রা জানান, পড়া লেখায় দিদার বলী প্রাথমিকের গণ্ডি পেরোতে পারেনি। একসময় চট্টগ্রামের কোন এক ফলের দোকানে কাজ করে কোনোরকমে দিনাতিপাত করতেন। পরে এলাকায় ফিরে জুয়া খেলায় মেতে উঠেন। এরপর সুঠাম দেহের দিদার কুস্তি প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে ধীরে ধীরে সুনাম কুড়িয়েছেন। চট্টগ্রামের এতিহ্যবাহী ‘জব্বারের বলীখেলা’য় ১২ বার চ্যাম্পিয়নও হয়েছেন তিনি। যুগ্মভাবে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন আরও তিনবার। দুর্দান্ত এই ক্যারিয়ার কাজে লাগিয়ে জড়িয়ে পড়লেন মাদক করবারে। সারাদেশের ভয়ংকর মাদক মাফিয়াদের সঙ্গে নেটওর্য়াক তৈরী করে বড় বড় মাদকের চালান পাচারে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন। এভাবে জনপ্রিয়তার মুখোশের আড়ালে থেকে নির্বিঘ্নে চালিয়ে গেছেন ইয়াবা পাচার। মাদকের বদান্যতায় বনে গেলেন কোটিপতি। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়িয়ে বেশি দুর যেতে পারেনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৮ সালের ২৮ জুন ময়মনসিংহে বিপুল ইয়াবা নিয়ে দুই বন্ধুসহ আটক হন দিদার বলী। অভিযোগ আছে, সেসময় মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে মাত্র ২০০পিস ইয়াবা দিয়ে তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। ১১ দিন কারাভোগও করেন। ময়মনসিংহে ইয়াবা নিয়ে আটকের ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছিল। তার মতো একজন দর্শকপ্রিয় বলীর এমন কাণ্ডে চারদিকে ঘৃণা সৃষ্টি হয়েছিল। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি তার ভক্তরাও এই নিয়ে ক্ষুব্ধ হন। মাদকসম্পৃক্ত ব্যক্তি হিসেবে তাকে ক্রীড়াঙ্গন থেকে বাদ দেওয়ার দাবি ওঠে। জনদাবির মুখে বলীখেলা থেকে বাদ পড়ে দিদার বলীর নাম। এরপর থেকে এলাকায় ফিরে চরিত্র পাল্টাতে থাকে দিদার। এরপর শুরু হয় তার আধিপত্য ও নানামুখী তৎপরতা। ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে জিম্মি করে নিয়ন্ত্রণে নেন পুরো এলাকাবাসীকে। কেউ প্রতিবাদ করলে তার উপর নেমে আসে নির্যাতনের খড়ক। ভয় তার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খোলার সাহস না করায় এভাবে জিম্মি করে রাখে পুরো ইউনিয়নবাসীকে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাবা আশরাফ আলীপাঁচবার ইউপি সদস্য নির্বাচনে অংশ নিয়ে একবার নির্বাচিত হন। এই নির্বাচনের নেশা তাকে আর্থিকভাবে সর্বস্বান্তকরে। ফলে সব জমিজমা বিক্রি করে একমাত্র সুপারিবাগান আর ভিটেই অবশিষ্ট থাকে সম্বল হিসেবে। প্রতিবছরের বৈশাখ আসলে বিভিন্ন স্থানে বলী খেলায় অংশ নিয়েও কিছু টাকা আয় করেন দিদার বলী। তবে তা সংসার চালানোর জন্য যথেষ্ট ছিল না। মাঝখানে স্থানীয় উমখালী স্টেশনে একটি মুদির দোকান দেন দিদারের বাবা আশরাফ আলী। কিন্তু তা বেশিদিন টেকেনি। পাঁচবছর আগে আলাদিনের চেরাগ পেয়ে যান দিদার বলী। দ্রুত বদলাতে থাকে আর্থিক অবস্থা। উমখালী স্টেশনে বেশি দাম দিয়ে প্রায় ৫ গন্ডা জায়গা কিনে রাতারাতি পাকামার্কেট তৈরি করেন। আজিজুল হক নামের এক ভাইকে পাঠান সৌদি আরবে। কিন্তু তিনি সেখানে বেশিদিন টিকতে পারেননি। চলে আসেন দেশে। তাকে ঢাকঢোল পিটিয়ে বিয়ে করান দিদার বলী। কিন্তু ওই বিয়ে বেশিদিন টিকেনি। দ্বিতীয়বার আবারও ঢাকঢোল পিটিয়ে বিয়ে করান ভাইকে। দিদার বলীর বাবা আশরাফ আলী একসময় আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ২০১৪ সালে উপজেলা নির্বাচনে দিদারুল আলম ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে চতুর্থ হন। এরপর পরবর্তী নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয়ের আশায় সপরিবারে বিএনপির রাজনীতিতে যোগ দেন। তবে জেলা বিএনপি ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের সঙ্গে সমান যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন তিনি। এভাবে ইয়াবা থেকে পাওয়া বিপুল অর্থ নিজপ্রভাব প্রতিপত্তি বাড়ানোর কাজে লাগান তিনি। ইয়াবা ব্যবসার বদনাম ঢাকতে এলাকায় ওয়াজ মাহফিলের আয়োজনও করেন। তাতে আর্থিকভাবে সহায়তা দেন। আর অর্থের গুণেই ওয়াজ মাহফিলে সভাপতিত্ব করেনপ্রাথমিক বিদ্যালয়ের গন্ডি পার না হওয়া দিদার। দিদার বলীর গ্রামে বাড়ি হলেও তিনি অনেক বছর নিয়মিত কক্সবাজার শহরের লাবনী পয়েন্টে বিলাসবহুল হোটেলের কক্ষ ভাড়া করে থাকতেন। সেখানে নিজস্ব বিশেষ পাহারা আছে। ফলে তার কক্ষে চাইলেই যখন তখন কেউ যেতে পারতো না।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, এক সময়ের রিক্তহস্ত দিদার বলী নিজ ষ্টেশনে, পানের ছড়া ও জ্বিনি ঘোনা এলাকায় ক্রয় করার পাশাপাশি দখল করেছেন বহু জমি। সেখানে গড়ে তুলেছেন বহুতল ভবন। এছাড়াও নিজ এলাকায় উমখালী ষ্টেশনে একটি অনুমোদনহীন করাতকল (সমিল) রয়েছে। অবৈধভাবে পরিচালিত এই করাতকলের মাধ্যমে বেপরোয়াভাবে চলছে বৃক্ষ নিধন ও কাঠ-খড়ির জমজমাট ব্যবসা। বাঁকখালী নদীতে বসিয়েছে দুটি ড্রেজার। যেগুলো দিয়ে রাত দিন উত্তোলন করা হচ্ছে বালু। ৫ আগষ্ট আ.লীগ সরকার পতনের দিন সন্ধ্যায় উমখালী স্টেশনে ৪ কক্ষ বিশিষ্ট একটি মার্কেট ভাংচুর ও অগ্নি সংযোগের পর দখলে নেন দিদার বলী। এছাড়াও ২ টি কার, ১ টি মোটরসাইকেল ও ১টি মিনিট্রাক রয়েছে। এই গাড়িগুলো মূলত মাদক পাচারের কাজে ব্যবহৃত হয় বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মিঠাছড়ির ৪নং ওয়ার্ডের পূর্বধর পাড়া থেকে মোটরসাইকেলে করে উপজেলায় আসছিলেন শহীদ ও মাহমুদ। তাদের দু’জনের কালো জ্যাকেট ধুলোয় সাদা হয়ে গেছে। জামা-কাপড় থেকে শুরু করে চোখ-মুখ সবখানে ধুলার আস্তরণ। বাতাসেও উড়ছে ধুলা। রাজারকুল-মিঠাছড়ি সড়কের চলাচলকারী পথচারীরা এমন অবস্থায় পড়ে। ধরপাড়া এলাকার পশ্চিমের বিলে ২ টি, গণি সওদাগর পাড়া বিলে ২ টি, রাজারকুল ১ নং ওয়ার্ড মৌলভী পাড়া বিলে ১টি, ৪ নং ওয়ার্ড পূর্ব উমখালী ফল্লানের বিলে ১ টি স্কেবেটর দিয়ে দিন রাত সমান তালে ফসলী জমির মাটি কাটছে দিদার বলী। আর এইসব মাটিবাহী ট্রাক পুরো গ্রামীণ সড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। মাটিবাহী ট্রাকের কারণে ধুলোয় প্রায় অন্ধকার থাকে পুরো এলাকা। পথচারীদের চোখ মুখ বন্ধ করে নাক চেপে ধরে সড়কে চলাচল করতে হচ্ছে। দোকানপাট, হোটেল সবকিছুতে ধুলোর আস্তর জমছে। উড়তে থাকা ধুলোবালিতে ঝাপসা হয়ে আসে দৃষ্টিসীমা। সড়কটি দিয়ে চলাচলকারী হাজার হাজার মানুষকে নিয়মিত ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত ধুলাবালির কারণে কারণে তৈরি হয়েছে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি। এতে মানুষের সর্দি, চর্মরোগ, কাশিসহ শ্বাসকষ্টজনিত রোগ বাড়ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলেও নির্যাতনের ভয়ে দিদার বলীর বিরুদ্ধে কেউ মুখ খোলার সাহস করছেন না।
স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, কয়েক মিনিট পর পর মাটিভর্তি ডাম্পার চলাচলের কারণে সড়ক ভেঙ্গে তছনছ হয়ে পুরো ঘরবাড়ি ধুলোময় হয়ে যাচ্ছে। রাত হলে ডাম্পারের সংখ্যা বাড়ে কয়েকগুণ। এছাড়াও রাত হলে গর্জে উঠে দিদার বলীর কয়েকটি ড্রেজার। একারণে ঠিক মতো ঘুমতো দুরের কথা; ছেলে মেয়েরা পড়া-লেখা করতে পারছেন না। তারপরও আমরা দিদার বলীর বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারবোনা; বললে বিপদ আছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক শিক্ষক বলেন, দিদার বলীরা এক সময় নিম্নবিত্ত আয়ের মানুষ থাকলেও অবৈধ ব্যবসা আর জবর দখলে সে এখন অনেক বিত্তশালী। তার পেটোয়াবাহিনীর বদৌলতে তিনি এলাকার ক্ষমতাধর বনেছেন। বহু বছর ধরে এলাকার মানুষের ওপর নিজের সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছেন। তার বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস এখন কারো নেই।
জানতে চাইলে দিদার বলী প্রথমে এইসব অভিযোগ অস্বীকার করলেও পরে বালু উত্তোলনসহ মাটি কাটার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, সন্ধ্যা হলে শত শত ডাম্পারভর্তি মাটি ইটভাটায় নেওয়া হয় এ কথা সত্য। তবে সবগুলো গাড়ি আমার নয়।
জানতে চাইলে রামু উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো: রাশেদুল ইসলাম বলেন, পরিবেশ ধ্বংসের দায়ে দিদার বলী নামের ওই ব্যক্তিকে বহুবার জরিমানা করা হলেও তাকে থামানো যাচ্ছেনা। এখনি এসিল্যান্ডকে বলে দিচ্ছি যেন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন
এমআর