এক সময়ের ওষুধ কোম্পানির সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভের চাকরি করে সংসার চালাতে পারতেন না হায়না মোবারক। সংসার চালাতে চাকরি ছেড়ে ১৯৯৬ সালে জাল টাকার ব্যবসা শুরু করেন তিনি। পাঁচ বছর পর ২০০১ সালে তৎকালীন ঢাকা ডিবির এডিসি মুন্সি আতিকের হাতে জাল টাকাসহ আটক হন তিনি। পরে ১৯ দিন জেল খেটে জামিনে মুক্তি পান এই মোবারক।
পরের বছর অর্থাৎ ২০০২ সালে বিটিআই এর একটি রিয়েল এস্টেট কোম্পানিতে যোগদান করেন হায়না মোবারক। আর সেখান থেকে ২০০৮ সালে সিইও হিসাবে কনকর্ড গ্রুপে আসেন তিনি। এসময় গুলশান ১ এর পুলিশ প্লাজা নির্মাণের সময় সেকেন্ডারি বিজনেসের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে চাকরি থেকে অব্যাহত দিয়ে ২০১২ সালের ১৪ জানুয়ারি দুদকে ৩১ কোটি টাকা আত্মসাতের মামলা দায়ের করে কনকর্ড কর্তৃপক্ষ। যার মামলা নং-১০০। যে মামলাটি দুদকে এখনো চলমান রয়েছে।
জানা গেছে, জালিয়াতির টাকায় ২০১২ সালে তিনি এমএইচ গ্রুপ প্রতিষ্ঠিত করেন। এই গ্রুপের রয়েছে চারটি শাখা প্রতিষ্ঠান। এরমধ্যে সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়নের গোলাপগ্রাম একটি লেক আইল্যান্ড আবাসন প্রকল্প। লেক আইল্যান্ড প্রজেক্টের প্রধান ফটকের সামনে নির্মাণাধীন ওই বাংলো বাড়িটি সম্পূর্ণ সরকারি খাস জমির উপরে নির্মিত হচ্ছে। সবকিছু জেনেও ভয়ে তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে সাহস পায় না।
অনুসন্ধানে জানা যায়, এই হায়না মোবারক আওয়ামী লীগের এমপি মন্ত্রী ও সাবেক ডিএমপির পুলিশ কমিশনার আসাদুজ্জামান ও সাভার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহিল কাফির প্রভাব খাটিয়ে রাতের আঁধারে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিতেন নিরীহ কৃষকের জমিতে। জমি দখলে বাঁধা দিলেই চলতো সন্ত্রাসী ক্যাডার বাহিনী দিয়ে নির্যাতন, দেওয়া হতো হয়রানিমূলক মামলা। শুধু কৃষকের জমি নয়, সরকারি জমিও দখল করে লেক আইল্যান্ডের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছেন মোবারক। এছাড়া জমির বায়না করেই দখলে নেওয়া, ক্রয়কৃত জমির বাহিরে অতিরিক্ত জমি দখলে নেওয়াসহ বিস্তর অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এসবের প্রতিবাদ করলে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে গুলি করার হুমকি দেন ভূমিদস্যু মোবারক।
শুধু তাই নয়, এই লেক আইল্যান্ড প্রকল্পে বর্তমানে রয়েছে ১ হাজার ৫০টি প্লট। এসব প্লটের বেশিরভাগই সরকারি খাস ও জোরপূর্বক দখলে নেওয়া অন্যের সম্পত্তি। গোলাপগ্রাম এলাকার স্থানীয়রা বাইরের কোন ব্যক্তির কাছে তাদের সম্পত্তি বিক্রি পর্যন্ত করতে পারেন না মোবারক হোসেনের তাণ্ডবে। কোনো লেক আইল্যান্ডের বাহিরে স্থানীয়দের কাছ থেকে জমি ক্রয় করতে চাইলে মোবারক বাহিনীর সন্ত্রাসীদের ধাওয়া খেয়ে এলাকা ছাড়তে হয় তাদের। অনেকে আবার নিজের ক্রয়কৃত সম্পত্তিতেও আসতে পারছেন না বছরের পর বছর। ভূমিদস্যু মোবারকের এসব কর্মকাণ্ডে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে স্থানীয়দের জনজীবন।
হায়না মোবারকের ভূমিদূস্যতা হয়ে উঠার ব্যাপারে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়ে লেক আইল্যান্ডের সাবেক একাউন্টস ডিজিএম রুহুল কুদ্দুস বলেন, জাল টাকার মামলা ২০২২ এসে এক বিচারপতির মাধ্যমে তিনি ৭০ লক্ষ টাকায় ম্যানেজ করেন, যা সিটি ব্যাংকের একটি একাউন্টের মাধ্যমে দেওয়া হয়। এছাড়া হায়না মোবারক বর্তমানে যে বাসায় বসবাস করেন গুলশানের ১০৭ নম্বর রোডের ১৬নং হাউজের (৩-বি) ফ্ল্যাট। সেই ফ্ল্যাটের রেজিস্ট্রেশনের সময় দেড় কোটি টাকা গোপন করে ক্রয় করে। যার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালে দুদক একটি মামলা করেন। মামলা নং- ০৬।
তিনি আরও জানান, হায়না মোবারক ক্লায়েন্টদের কাছ থেকে প্লট বিক্রি করার টাকা লাবনি ট্রাভেল এজেন্সি খান সাহেবের মাধ্যমে মানি লন্ডারিং করে গ্রাহকের কিস্তির হাজার কোটি টাকার কানাডায় পাচার করেছে। তার ছোট ছেলে কানাডার ভানকুপারে অধ্যানরত ফাহাদ হোসেনের টিডি একাউন্টসে এসব টাকা পাচার করা হয়।
এসব অভিযোগের ব্যাপারে হায়না মোবারকের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি নিজের ব্যবহৃত ফোনে কল রিসিভ করে নিজের পরিচয় গোপন করে বলেন, নম্বরটি মোবারকের নয়, এটি তার আত্মীয়ের নাম্বার। তিনি কোম্পানির কমকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করতে বলেন।
সরকারি সম্পত্তিতে বহু দল ভবন নির্মাণ ও অবৈধ হাউজিং কোম্পানির ব্যাপারে সাভার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু বকর সরকার বলেন, সরকারি খাস জমিতে ভবন নির্মাণ করার সুযোগ নেই। আমি এই হাউজিং'র কাগজপত্র দেখে আইনানুগ ব্যবস্থা নেব।