কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীতে ব্রি ১০৩ ধানের বীজ রোপণ করে শতাধিক কৃষক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। বীজ রোপণের পর নির্দিষ্ট সময়ের আগেই ধানের শীষ গজানোর ফলে ধানে চিটা ধরাসহ ফলন বিপর্যয়ের আশঙ্কায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন ভুক্তভোগী কৃষকরা।
কৃষকের অভিযোগ, বাজারের একটি দোকান থেকে বীজ কিনে এ প্রতারণার শিকার হয়েছেন তারা। মাঠে দেড় শতাধিক বিঘা জমিতে বীজ রোপণের পর নির্ধারিত সময়ের আগেই ধানের শীষ গজিয়েছে। এতে করে ধানে চিটা লাগাসহ ফলন বিপর্যয়ের মুখে পড়েছেন তারা। এই অবস্থায় আর্থিক লোকসানের মুখে পড়েছেন কৃষকরা।
ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা জানান, এক বিঘা জমিতে সেচ খরচ, কীটনাশক খরচ, জমিতে নিয়োগ করা শ্রমিক খরচ হয়েছে সাড়ে ১২ হাজার টাকা। যদি এ ধানের ফলন হতো তাহলে তারা বিঘা প্রতি ১৭ হাজার টাকার ধান পেতো। এ ধান রোপণ করতে অনেকেই চড়া সুদে বিভিন্ন ব্যক্তি ও এনজিও’র কাছ থেকে লোন নিয়েছেন। এতো টাকা খরচ করেও কাঙ্ক্ষিত ফলন না পাওয়ার দুশ্চিন্তায় ভুগছেন কৃষকরা। তারা এর ক্ষতিপূরণ দাবি করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আশপাশের ইউনিয়নে অবৈধভাবে গড়ে উঠা দোকান থেকে ধান বীজ কিনে জমিতে রোপন করেছেন কৃষকরা। কিছু এলাকায় চাষাবাদ ভাল হলেও একাধিক এলাকায় রোপনকৃত ধান ক্ষেত মরে যাচ্ছে, আবার লালচে হয়ে যাচ্ছে। বিপুল টাকা খরচ করে জমিতে চাষ করে ধানক্ষেত মরে যাওয়ার উপক্রম হওয়ার কারনে বর্তমানে ভুক্তভোগী কৃষকদের মাঝে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। এদিকে ভেজাল বীজ কিনে কৃষকরা প্রতারিত হলেও উপজেলা কৃষি বিভাগ এব্যাপারে অনেকটা নির্বিকার বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা।
এদিকে বিভিন্ন বীজের দোকান ঘুরে দেখা যায়, সরকারি বীজের পাশাপাশি বিভিন্ন নামিদামি কোম্পানির বীজ বিক্রি করা হচ্ছে। এছাড়াও অনেক প্রতিষ্ঠানের বীজ বিক্রি করা হচ্ছে যাদের নেই সরকারি বীজ প্রত্যয়নকারী সংস্থার সনদ। এমনকি অনেক দোকানদার নিজেরাই বীজ উদ্ভাবন করে তা চমকপ্রদ প্যাকেটে ভরে কোনো প্রকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই তা কৃষকদের কাছে বিক্রি করছেন। এসব দোকান থেকে বীজ কিনে প্রতারিত হচ্ছেন কৃষকরা।
কৃষি বিভাগ জানায়, নতুন জাতের ধানের মাঝে ১০৩ ধানের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে কৃষকদের। তবে যারা বিভিন্ন কোম্পানির ব্রি ১০৩ ধান রোপন করেছে তাদের ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিয়েছে। যারা বিডিসির বীজ রোপন করেছে তাদের ফলন অনেক ভালো হয়েছে।
সরেজমিনে মসূয়া ইউনিয়নের পং মসূয়া গ্রামের কয়েকজন ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের জমি ঘুরে দেখা গেছে, রোপণের ৭৫ দিন পরও ধান গাছগুলো পর্যাপ্ত বাড়েনি। ছোট ধানগাছেই অপরিপক্ব শিষ চলে এসেছে। শিষে আবার চাল নেই। সার পানি দিয়েও কোন কাজ না হওয়ায় হতাশ হয়ে অনেকে ধান কেটে গরুকে খাওয়াচ্ছেন। তবে পাশের খেতে ভালো মানের ধান বীজ রোপণ করায় খুব ভালো ফলন হয়েছে।
মসূয়া ইউনিয়নের পং মসূয়া গ্রামের কৃষক মো. ইব্রাহিম মিয়া জানান, বাজার থেকে ইমারান সিডস ব্রি-১০৩ জাতের ধানের চারা রোপণ করে প্রতারণার শিকার হয়েছেন তিনি। ধানের শিস বের হওয়ার পর দেখা যায় অধিকাংশ ধানের শিস চিটা হয়ে মরে যাচ্ছে। তিনি আরও জানান, ওই বীজ দোকানে নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু দোকানদার বলেন এখানে আমার কিছু করার নাই। কোম্পানির জিনিষ। তোমার হয়তো নিয়মকানুন ঠিক ছিল না। কিন্তু ওই কোম্পানির ধান তিনি পাঁচ বছর ধরে রোপণ করেন। এতে ফলন বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন তিনি।
আচমিতা ইউনিয়নের অগ্রিয়েকোনা গ্রামের কৃষক নুরু মিয়া বলেন, বাজার থেকে পুরাতন ধান দিয়েছে একজন। কিন্তু ধান হয়নি। এটা শুধু আমার একা নয়। আরও প্রায় ৮ থেকে ১০ জনের একই ক্ষতি হয়েছে।
পং মসূয়া গ্রামের কৃষক হেলাল উদ্দিন বলেন, বাজার থেকে বীজ কিনে জমিতে রোপণ করে আমাদের সর্বনাশ হয়েছে। এ ধান দিয়ে আমাদের পরিবারের সারা বছরের তিন বেলা খাবার জোটে। কিন্তু এখন এসব জমির ধান চিটা হয়ে ফলন বিপর্যয় ঘটেছে। আমরা পরিবার নিয়ে কি খাব?
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. শফিকুল ইসলাম ভুঞা জানান, ব্রি ১০৩ ধানসহ অন্যান নতুন জাতের ধান রোপন করার জন্য কৃষকদেরকে দিকনির্দেশনা দিয়েছি। যাতে কৃষকরা ভেজাল বীজ কিনে কোন ধরণের প্রতারণা বা ক্ষতির শিকার না হন। অনেক দোকানে ভাল মানের বীজ বিক্রি করা হলেও কিছু অবৈধ মুনাফালোভী দোকানী কারসাজির মাধ্যমে ভেজাল বীজ বিক্রি করে কৃষকরা ঠকাচ্ছে। আমরা মাঠ পর্যায়ে পর্যবেক্ষণ করছি। বীজ বাহিত কারণে ফসলের ক্ষতি হলে আমরা বীজ কোম্পানির বিরুদ্ধে প্রয়োজন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আবুল কালাম আজাদ জানান, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা তৈরি করা হবে। সরকারের কোনো বরাদ্দ এলে, তাদের সহায়তা করা হবে।
এইচএ