হাবিবুর রহমান, পেশায় একজন বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা। হাতে ব্যাগ নিয়ে হাঁটছেন কুমিল্লা নগরীর রেসকোর্স থেকে কান্দিরপাড়মুখী সড়কের দিকে। ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছেন ও সামনের দিকে হাঁটছেন। আগ্রহ থেকেই প্রতিবেদক জানতে চাইলেন, কোনো সমস্যায় পড়েছেন কিনা। পায়ের গতি কমিয়ে এক রাশ আক্ষেপ নিয়েই বললেন, 'রাস্তায় যেই পরিমাণ জ্যাম, রিকশার চাইতে পায়ে হেঁটেই দ্রুত পৌঁছানো সম্ভব হবে। ঠিক টাইমে পৌঁছাতে না পারলে চাকুরী থাকবে না, ভাই।' এই জ্যামের কারণ হিসেবে হাবিবুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি ক্ষোভ ঝেড়ে বলেন, 'যানজটের কারণ তো এই অটোরিকশাগুলো ভাই। এদের নিয়ম শৃঙ্খলা নেই। ট্রাফিক জ্ঞান নেই। রাস্তার একটু খালি ফেলেই গাড়ির মাথাটা ঢুকিয়ে দিয়ে বসে থাকে। পরে লেগে যায় লম্বা যানজট, আধা ঘণ্টাতেও আর সেই জ্যাম ছাড়ানো যায় না।' — শুধু হাবিবুর রহমানের নয়, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও থ্রী হুইলার এমন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে কুমিল্লা নগরীর ১৫ লক্ষ মানুষের। বারবার নিষেধাজ্ঞার কথা শুনা গেলেও সেগুলো প্রয়োগের যেন কোনো নাম নেই। নাটকীয়তার যেন শেষ নেই। কুমিল্লাবাসী এক প্রকার ক্ষোভ নিয়েই কুমিল্লা নগরীকে 'অটোরিকশার নগরীও' বলে থাকেন।
এদিকে, কুমিল্লা নগরীতে ব্যাটারীচালিত অটোরিকশা ও থ্রী হুইলারের দৌরাত্ম্যে জনজীবনে নেমে এসেছে স্থবিরতা। বারবার নিষেধাজ্ঞা দিয়েও বন্ধ করা যাচ্ছে না এসব ইজিবাইক। এর ফলে, নগরীতে যানজট তীব্র আকার ধারন করেছে। তৎকালীন সিটি কর্পোরেশন মেয়র নানা উদ্যোগ নিলেও তা কার্যকর হচ্ছে না। বিদ্যুৎ এর এমন সমস্যা থাকা সত্ত্বেও বিদ্যুৎ চালিত এসব যানবাহন তথা ইজিবাইকের বিরুদ্ধে কোনো রুপ ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। কিন্তু বিদ্যুতের সিংহভাগ যাচ্ছে এ ইজিবাইকের পেটে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কুমিল্লা নগরীর প্রায় ৮০ শতাংশ গ্যারেজে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগে চার্জ দেয়া হচ্ছে ব্যাটারিচালিত এসব যানবাহন। এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো নির্দেশনা জারি না হওয়ায়, নগরজুড়ে চলছে ব্যাটারিচালিত রিকশার আধিপত্য।
সূত্র জানায়, কুমিল্লা নগরীতে প্রায় ৪০ হাজার ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও থ্রী হুইলার চলাচল করছে। এগুলো অন্তত ৬০ হাজার চালক দুই তিন শিফটে সেগুলো চালিয়ে থাকেন। এতে শহরে প্রতিনিয়ত যানজট লেগেই থাকে। এছাড়াও, বেপরোয়া গতিতে চলাচল করার কারণে প্রতিনিয়তই ঘটছে নানা দুর্ঘটনা। এর প্রেক্ষিতে বিভিন্ন সময় এসব যানবাহন বন্ধের দাবি ওঠে। ২০২৩ সালের শেষের দিকে কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে ৬ হাজার অটো রিকশাকে লাইসেন্স দিবে বলে ফর্ম বিক্রি করা হলেও আজও বাস্তবায়ন হয় নি সেই লাইসেন্স কার্যক্রম। নানা নাটকীয়তায় ভেস্তে গিয়েছে সেগুলোও।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও সংশ্লিষ্টদের নিয়মিত মাসোহারা দিয়েই রাস্তায় চলছে অটোরিকশা। জেলা ট্রাফিক বিভাগ বিভিন্ন সময় অটোরিকশা তুলে নিলেও সেগুলোর জরিমানা পরিশোধ করে আবারো রাস্তায় নেমে দাপিয়ে বেড়ায় অটোরিকশাগুলো। এসব ধরা-ছাড়ার খেলা কবে শেষ হবে, সেটাও জানেনা নগরবাসী।
নগরীর তালপুকুরপাড় এলাকার বাসিন্দা কামরুল হাসান বলেন, বর্তমানে নগরীর বিভিন্ন সড়কে হেঁটে চলাচল করাও কঠিন হয়ে পড়েছে। দিনভর যানজট লেগে থাকে। অটোরিকশাগুলোর কারণে এত যানজট। এগুলো কমানো গেলে যানজট কিছুটা কমতো।
রেসকোর্স এলাকার বাসিন্দা কাইউম কিবরিয়া বলেন, প্রতিটি সড়কেই অটোরিকশার জটলা। সড়কের একপাশ থেকে অন্যপাশে যাওয়া যায় না। এগুলো ঝুঁকিপূর্ণ আবার বেপরোয়াও। প্রশাসন এখনি উদ্যোগ না নিলে, নগরবাসীর ভোগান্তি এর জন্য দিন দিন আরো বাড়বে।
কুমিল্লা জেলা ট্রাফিক পুলিশের ইনস্পেকটর (অ্যাডমিন) কামাল পাশা বলেন, কুমিল্লা নগরীতে আগের চেয়ে ১০-১২ হাজার অটোরিকশার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। সিটি করপোরেশন যদি অটোরিকশার সংখ্যা নির্ধারণ করে দিত, তাহলে আমরা সে অনুসারে পদক্ষেপ নিতাম। তিনি বলেন, বিপুলসংখ্যক বৈধ-অবৈধ যানবাহন স্বল্পসংখ্যক ট্রাফিক পুলিশ দিয়ে সামলানো খুবই কঠিন। এসব অবৈধ যানবাহনের বিরুদ্ধে আমরা কিছু কিছু অভিযান পরিচালনা করছি। কিন্তু তাতেও তেমন একটা ফলাফল আসছে না।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জিপি চৌধুরী বলেন, সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া এ যানজট নিরসন করা সম্ভব নয়। বিষয়টি নিয়ে আমরা জেলা প্রশাসনের সমন্বয় সভায় আলোচনা করব।
কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মোঃ আমিরুল কায়সার এ প্রতিবেদককে বলেন, নগরীতে অটোরিকশার পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে। আমরা সংশ্লিষ্ট স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করে প্রয়োজনের অতিরিক্ত থ্রি-হুইলারগুলোকে শহরের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেব।
এইচএ