বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত ৪ আগস্ট দুপুরে সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানার সামনে কলেজছাত্র শিহাব আহমেদ (২২) মাদ্রাসা শিক্ষার্থী সিয়াম হোসেন (১৯) ও তাঁত শ্রমিক ইয়াহিয়া আলী (৩৫) গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন।
শিহাব আহমেদ নিহতের ঘটনায় গত ২০ আগস্ট ৩৩ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেছেন স্থানীয় এনায়েতপুর থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ন-আহবায়ক সোলায়মান হোসেন। আর সিয়াম হোসেনের মৃত্যুর ঘটনায় ২১ আগস্ট এনায়েতপুর থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ন-আহবায়ক হযরত আলী বাদী হয়ে ৮৯ জনকে আসামি করে একই থানায় পৃথক আরও একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন।
এদিকে পারিবারিক সুত্রে জানা যায়, মামলার বিষয়ে জানেন না নিহতের পরিবারা। সেইসঙ্গে কে বা কারা বাদী হয়ে এই হত্যা মামলাটি করেছে তাকেও তাঁরা চেনেন না। এছাড়া ময়নাতদন্তের জন্য লাশ কবর থেকে তুলতে দেওয়া হবেনা বলে পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
নিহত শিহাব আহমেদের মা শাহনাজ পারভীন কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, আমার ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে সেজন্য আমরা পুরো পরিবার চরমভাবে কষ্ট পাচ্ছি। এর জন্য মামলা দিয়ে কোনো নিরপরাধ মানুষকে হয়রানি করতে চাই না। কে মামলা দিয়েছে তাঁকে আমরা চিনি না। কাউকে মামলা দেওয়ার অনুমতি দেইনি। কার বিরুদ্ধে মামলা করবো যে পুলিশের গুলিতে আমার সন্তান নিহত হয়েছে সে পুলিশ জনরোষের শিকার হয়েছে। আল্লাহ তাদের বিচার করেছেন। আমরা এ বিচার আর চাই না।
শিহাবের বৃদ্ধ দাদী সাহিদা বেগম (৬০) বলেন, আমার সোনার টুকরো নাতি ভাই কত যত্ন করে বড় করছিলাম। এভাবে জীবন দিতে হবে কখনো চিন্তাও করি নাই। ভাগ্যের লিখন। এখন কবরে সে শাস্তিতে থাকুক এটাই আমরা কামনা করি।
নিহত শিহাবের স্বজন সাহিদা বেগম বলেন, শুনলাম এই হত্যার ব্যাপারে কে বা কারা মামলা দিয়েছে। আমরা এই মামলা চাই না। পুলিশ আসছিল ময়নাতদন্তের জন্য কবর থেকে লাশ তুলতে চায়। আমরা কোন অবস্থাতেই এই লাশ তুলতে দেবনা।
নিহত কলেজ শিক্ষার্থী শিহাব আহমেদ সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার মাধবপুর গ্রামের শাহনাজ পারভীন ও প্রবাসী শফি মিয়া দম্পতির বড় ছেলে। সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থেকে এবার এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল। সম্প্রতি এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশ হলে সেখানে জিপিএ-৪ দশমিক ০৮ পেয়েছে শিহাব। বিএনসিসি ক্যাডেটসহ গ্রামে নানা সামাজিক কর্মকান্ডের সাথে তাঁর সস্পৃক্ততা ছিল।
আন্দোলনের কারণে পরীক্ষা স্থগিত হওয়ার ছুটিতে বাড়িতে এসে এলাকায় বন্ধুদের সবার সঙ্গে সেদিন আন্দোলনে অংশ নিয়ে এনায়েতপুর থানা এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয় শিহাব। পরে তাঁর সহপাঠীরা তাঁকে উদ্ধার করে স্থানীয় খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। স্বজনেরা খবর পেয়ে প্রতিকৃল অবস্থায় ময়নাতদন্ত ছাড়াই তাঁর মরদেহটি গ্রামের বাড়িতে নিয়ে স্থানীয় আজুগড়া কবরস্থানে দাফন করেন।
অপরদিকে মাদ্রাসা শিক্ষার্থী সিয়াম হোসেন বেলকুচি উপজেলার গোপরেখী গ্রামের লাকী বেগম ও আবদুল কুদ্দুস দম্পতির ছেলে। স্থানীয় মাদ্রাসা থেকে কোরআনের হাফেজ হয়ে মাওলানা হবার আশায় সেখানেই আবারও পড়ালেখা শুরু করেছিলেন সিয়াম। পাশাপাশি স্থানীয় বেতিল বাজার এলাকায় নজরুল মুছা জামে মসজিদের মোয়াজ্জিমের দায়িত্ব পালন করতেন। এলাকায় বন্ধুদের সঙ্গে সেদিনের আন্দোলনে অংশ নিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। প্রতিকূল অবস্থায় তাকেও ময়নাতদন্ত ছাড়াই স্থানীয় আজুগড়া কবরস্থানে নিহত শিহাবের কবরের পাশে দাফন করা হয়।
নিহত সিয়াম হোসেনের মা লাকী বেগম বলেন, আমার ছেলে কোরআনের হাফেজ ছিল। সে শহীদ হয়েছে। কে এই হত্যাকান্ড করেছে আমরা তাদের দেখিনি। কাউকে মামলা দিয়ে এখন তাদের অভিশাপ নিতে চাই না। যারা মামলা দিয়েছে তাদের এই মামলা তুলে নিতে হবে। তা না হলে আমার ছেলের লাশ যদি জোর করে কবর থেকে তুলতে আসে তাহলে আমরা তাদের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে মামলা করবো।
সিয়ামের বাবা আবদুল কুদ্দুস বলেন, সিয়ামের সহপাঠীদের কাছে শুনেছি পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে। ওই দিনের ঘটনায় ১৫ জন পুলিশ সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে। এখন আর কাউকে আসামি করে আমরা মামলা দিতে চাই না। আমরা কাউকে মামলা দিতে বলিও নাই। কে মামলা দিয়েছে তাও জানি না। এখন পুলিশ তদন্তের জন্য লাশ কবর থেকে তুলতে চায়, আমরা লাশ তুলতে দেব না। পুলিশকে বলেছি দয়া করে আমাদের কষ্ট আর দীর্ঘায়িত করবেন না।
একই সাথে তাঁত শ্রমিক ইয়াহিয়া আলী নিহতের ঘটনায় গত ২১ আগস্ট নিহত ইয়াহিয়া আলীর স্ত্রী শাহানা খাতুন বাদী হয়ে ৮৬ জনের নামে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন।
তবে এ বিষয়ে তিনি জানান, 'মামলাটি দায়ের করতে তিনি ইচ্ছুক ছিলেন না। কিছু লোকজন এসে তার পুরো পরিবার ও সংসারের দায়িত্ব নিয়ে তার একটা সই নেন, পরে শুনতে পারেন এই সই দিয়ে থানায় এজাহার দেওয়া হয়েছে।'
শাহানা খাতুন আরও বলেন, 'মামলার বিষয় আমি কিছুই জানি না। এছাড়া কাদেরকে আসামি করা হয়েছে সে বিষয়েও বলতে পারব না।'
একইসঙ্গে ময়নাতদন্তের জন্য কবর থেকে লাশ উত্তোলনের বিষয়েও আপত্তি জানিয়েছেন শাহানা খাতুন। তিনি বলেন, 'কবর থেকে লাশ তুলতে গেলে আমার আপত্তি আছে।'
নিহত ইয়াহিয়ার বড় ভাই খোকন আলম বলেন, আমার ভাই কোনো দলের সক্রিয় নেতা বা কর্মী ছিল না। এই মামলার এজাহার তৈরিতে এনায়েতপুর থানা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব মঞ্জুর রহমান ও খুকনি ইউনিয়ন বিএনপির নেতা নজরুল ইসলাম সহযোগিতা করেছেন। আমরা ভাই হত্যার বিচার চাই। তবে কোন নিরীহ নিরপরাধ মানুষকে হয়রানির শিকার হোক, সেটাও চাই না।
নিহত তাঁত শ্রমিক ইয়াহিয়া আলী শাহজাদপুর উপজেলার খুকনি ঝাউ পাড়া গ্রামের চামেলি খাতুন ও শাহজাহান আলী দম্পতির ছেলে। গ্রামেই একটি তাঁত কারখানায় তাঁত শ্রমিকের কাজ করতেন ইয়াহিয়া। আন্দোলন চলাকালে এলাকায় বন্ধুদের সঙ্গে সেদিনের মিছিলে অংশ নিয়ে একই সময় গুলিবিদ্ধ হন ইয়াহিয়া আলী। বন্ধুরা তাঁকে উদ্ধার করে স্থানীয় খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বেলা পৌনে একটার দিকে তাঁর মৃত্যু হয়। প্রতিকৃল অবস্থায় ময়নাতদন্ত ছাড়াই তাঁর মরদেহটি গ্রামের আটার দাগ কবরস্থানে দাফন করা হয়।
এ তিনটি হত্যার ঘটনায় পৃথক তিনটি হত্যা মামলায় ২০৯ জনকে নামিয় আসামি করা হয়েছে। এবং প্রতিটি মামলাতেই ৫-৭০০ জনকে অজ্ঞাত হিসেবে যুক্ত করা হয়েছে।
মামলায় উল্লেখ্যযোগ্য যাদের আসামি করা হয়েছে, তারা হলেন- সিরাজগঞ্জ-৫ (বেলকুচি-চৌহালী) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল মমিন, তাঁর ছোট ভাই আবদুল আলিম মন্ডল, তার চাচাতে ভাই জুবায়ের মন্ডল, বেলকুচি উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম, চৌহালী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান তাজ উদ্দিন, বেলকুচি পৌরসভার সাবেক মেয়র সাজ্জাদুল হক, শাহজাদপুর পৌরসভার মেয়র মনির আক্তার সিরাজগঞ্জ ইকোনমিক জোনের পরিচালক শেখ মনোয়ার হোসেন, বেলকুচি উপজেলার তামাই গ্রামের তিন ব্যবসায়ী ফজলার রহমান তালুকদার, শেখ শামীম ও আবু হেনা।
মামলায় নামিয় অন্য আসামিদের মধ্যে আরও রয়েছেন- এনায়েতপুর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি আহম্মদ মোস্তফা খান বাচ্চু, জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি রাশেদুল ইসলাম, এনায়েতপুর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আজগর আলী, চৌহালী উপজেলার সদিয়া চাঁদপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম, বেলকুচি উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রকি সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান হাবিব, চৌহালী উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক বাবুল আক্তার ও সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুর রহমান চুন্নু, স্থল ইউপি চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম, জালালপুর ইউ চেয়ারম্যান সুলতান মাহমুদ, ধুকুরিয়া বেড়া ইউপি চেয়ারম্যান হেলাল প্রামানিক, ভাঙ্গাবাড়ি ইউপি চেয়ারম্যান জহুরুল ইসলাম, খাস কাউলিয়া ইউপি চেয়ারম্যান আবু সাঈদ, সদিয় চাঁদপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম, কৈজুরীর সাবেক চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম।
এসব বিষয়ে এনায়েতপুর থানা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব মঞ্জুর রহমান বলেন, দুইটা হত্যা মামলা পরিবারের অনুমতি নিয়েই দলীয় নেতৃবৃন্দ দায়ের করেছেন। অপর একটি আমাদের খুকনিতে ইয়াহিয়া হত্যার ঘটনায় তাঁর স্ত্রী বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেছন। আমরা সহযোগিতা করেছি। তবে এই মামলাগুলোতে যারাই আসামি হয়েছেন তারা সবাই কোনো না কোনোভাবে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই হত্যার সঙ্গে জড়িত বলেই তারা আসামি হয়েছেন।
লাশ উত্তোলনের বিষয়ে তিনি বলেন, এখন এটি পরিবারের কোনো বিষয় নয়। আদালতের নির্দেশে প্রশাসন এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবেন।
এদিকে কলেজ শিক্ষার্থী শিহাব আহমেদ হত্যা মামলার বাদী এনায়েতপুর থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহবায়ক কমিটির সদস্য সোলায়মান হোসেন বলেন, শিহাবের বাবা মালয়েশিয়াতে থাকেন তাঁর সঙ্গে মুঠোফোনে ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দলীয় লোকজনের কথা হয়েছে। সে অনুযায়ী মামলাটি দায়ের করা হয়। এখন কোনো চাপে পরে পরিবারের পক্ষ হতে এলোমেলো কথা বলতেই পারেন।
তিনি বলেন, ৪ আগস্ট হত্যার ঘটনায় কোন নিরপরাধ ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে এমনটি আমার জানা নেই। আসল কথা হচ্ছে এই হত্যার বিচার হতে হবে।
অন্যদিকে মাদ্রাসা শিক্ষার্থী সিয়াম হোসেন হত্যা মামলার বাদী এনায়েতপুর থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ন আহবায়ক হযরত আলী বলেন, মামলা দেওয়ার আগে সিয়াম হোসেনের পরিবারের সঙ্গে দলীয়ভাবে কয়েকজন তাদের বাড়িতে গিয়ে আলোচনা করা হয়েছিল। সে অনুযায়ী সিয়ামের বড় ভাইকে এই মামলার ১ নম্বর ও বাবাকে ২ নম্বর স্বাক্ষী করা হয়েছে। এখন তাঁরা কী কারণে বিষয়টি অস্বীকার করছেন আমি বুঝতে পারছি না। আমরা মামলা না দিলেও কোনো না কোনোভাবে এই হত্যার মামলা হতই।
এনায়েতপুর থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রওশন ইয়াজদানী বলেন, মামলার পর এনায়েতপুর আমলি আদালতের বিচারক তিনটি মামলাতেই একজন করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে লাশ কবর থেকে তুলে ময়নাতদন্তের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। এজন্য একইসঙ্গে ম্যাজিস্ট্রেট নিযুক্ত করতে জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। সে অনুযায়ী জেলা প্রশাসক ম্যাজিস্ট্রেট নিযুক্ত করেছেন। এখন আমরা নিহতের পরিবার ও ম্যাজিস্ট্রেটের সাথে যোগাযোগ করছি। শিগগিরই একটি দিনক্ষণ নির্ধারিত করে লাশগুলো উত্তোলনের ব্যবস্থা করা হবে।
এবি