নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ায় ভিটেমাটি দখল করার চক্রান্তে একটি অসহায় পরিবারকে জোরপূর্বক ঘর থেকে বের করে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। ৬ দিন ধরে বাড়ির উঠোনে কুয়াশাচ্ছন্ন খোলা আকাশের নিচে তাবু টাঙিয়ে কোনো মতে রাত্রী যাপন করছে পরিবারটি।
এমন তথ্যের ভিত্তিতে রবিবার (২৫ নভেম্বর) বিকেলে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, পরিবার-পরিজন নিয়ে বাড়ির উঠোনে মানবেতর জীবনযাপন করছে ভুক্তভোগী পরিবার।
এর আগে, গেল বুধবার (২০ নভেম্বর ) নোয়াখালীর হাতিয়া পৌরসভার লক্ষীদিয়া গ্রামের এমপির পোল সংলগ্ন ফখরুদ্দিনের বাড়িতে এমন ঘটনা ঘটে।
ভুক্তভোগী শাহেনা আক্তার (৪০) একই বাড়ির মৃত ফখরুদ্দিনের স্ত্রী। স্বামী মারা যাওয়ার পর সন্তান-সন্ততি নিয়ে স্বামীর ভিটে মাটিতে বসবাস শাহেনা আক্তারের। সেই স্বামীর ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে তারই ছোট ভাই ফখরুল ইসলাম পাশা (৪৮)। যে কারণে আজ সন্তান-সন্ততি নিয়ে খোলা আকাশের নিচে অনিরাপদ বসবাস এই অসহায় পরিবারের।
অমানবিক এই নিষ্ঠুরতার বর্ণনা শুনে ঘটনাস্থলে প্রতিবেদকের সন্ধ্যা অবধি সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা যায়, ভুক্তভোগী শাহেনা আক্তার ও তার ছেলে-মেয়েরা মিলে বাড়ির উঠোনে তাবু টাঙ্গিয়ে বসে আছে। শীতের রাতে ঘন কুয়াশায় আবৃত তাবুর চারিদিক। তাবুর নিচে চোখ যেতেই দেখা যায় যেনো- শরণার্থী শিবিরে আশ্রিতরা শীতে কাঁপছে। আসবাবপত্রসহ সবকিছু চারিদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে।
দুর্বিষহ এমন হৃদয়বিদারক ঘটনাচিত্র সম্পর্কে স্থানীয় বাসিন্দা রফিক মিয়া, আমজাদ, সাজ্জাদ, হুলারা বেগম, নুর ইসলাম, স্বপন ও আশরাফ সহ অসংখ্য মানুষের সাথে কথা হয়। তারা জানান, এই বাড়ির জমি কেনার সময় ফখরুদ্দীন মিয়া ব্যবসা করতেন। বিক্রেতাকে অল্প অল্প করে টাকা দিয়েছে। পরে নিজের নামে জমি কবলা করে বাড়ি তৈরি করেন। ঐ সময় ফখরুদ্দীন মিয়ার বাবা আজিজুল হক বাবর অসুস্থ ছিলেন, বাকি সবাই বেকার ছিল। ফখরুদ্দীন মিয়াকে ভাই- বোনেরা বহু কষ্ট দিয়েছে। অবশেষে তিনি মারাও যান। এখন তার স্ত্রী-সন্তানদেরও কষ্ট দিচ্ছেন ভাই-বোনেরা।
"এই বাড়িটি আমার স্বামীর। বিশ বাইশ বছর এই বাড়িতে বসবাস করেছি। বাড়িতে দু'টি ঘর ছিল। টিনের ঘরটি দেবর'রা ভেঙে নিয়ে গেছে আর আমি বিল্ডিংটিতে থাকি। আমার স্বামীকে তার ভাইয়েরা তিনবার পিটিয়েছে, পরে আমার স্বামী মারা যায়। এখন আমার দেবর, ননদেরা আর শ্বাশুড়ি মিলে চক্রান্ত করে আমাকে ঘর থেকে বের করে দিয়ে ঘরে তালা মেরে রেখেছে। গত ৬দিন ধরে আমি উঠানে তাবু টাঙ্গিয়ে থেকে ছেলেমেয়েদের নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। আমরা এখন কোথায় যাব ? কোথায় থাকবো ? কার কাছে বিচার চাইবো ? তারা বলছে আমার ছেলে আর মেয়ে জামাইকে মেরে ফেলবে। এখানে তারা আমাকে থাকতে দিবে না। মিথ্যা অভিযোগ এনে আমাদের বিরুদ্ধে জিডি করেছে। এর আগে তিন-চারটা মামলা দিয়ে আমাদেরকে শুধু হয়রানি করে যাচ্ছে। আমরা অসহায়। আমরা প্রশাসনের কাছে বিচার চাই।" এভাবেই করুন আকুতিতে ভয় আর উৎকণ্ঠায় অসহায়ত্বের কথা বলছিলেন ভুক্তভোগী শাহেনা আক্তার।
তিনি আরও বলেন, ২০০২ সাল থেকে বিক্রেতাকে এই বাড়ির ২৮ শতাংশ জমি কেনার টাকা ভেঙ্গে ভেঙ্গে পরিশোধ করে থাকে তার স্বামী ফখরুদ্দীন। পরে ২০১৭ সালে বাড়িটি তার স্বামীর নামে রেজিস্ট্রি হয়। বিক্রেতা প্রয়াত দিদার মিয়ার স্ত্রী ও ছেলেরা এখনো জীবিত আছে। অথচ তারা হিংসাত্মক ভাবে আমার শাশুড়িকে জিম্মি করে ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে আমাদেরকে হয়রানি করে যাচ্ছে। এলাকার সব মানুষ জানেন তারা আমাদেরকে কীভাবে অমানুষিক নির্যাতন করে যাচ্ছে। এমন নির্মমতায় পাড়া-প্রতিবেশীদের সমবেদনা করা ছাড়া তাদের ভয়ে আমাদেরকে সাহায্য সহযোগিতা করার মতো কোন সুযোগ নেই। অভাব-অনটন, দুঃখকষ্ট আর নিরাপত্তাহীনতায় নির্ঘুম রাত কাটে আমাদের। আমার দেবর ফখরুল ইসলাম পাশার চক্রান্তে ও তার বোনেদের সহযোগিতায় তাদের মাকে (আমার শ্বাশুড়ি)কে দিয়ে কলাকৌশলে এবং চাপপ্রয়োগ করে আমাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে তারা নির্যাতন ও হামলা করে যাচ্ছে বলে জানান এ ভুক্তভোগী নারী।
বাড়ির দলিলপত্র ও মামলার তথ্য সূত্রে জানা যায়, ভুক্তভোগী শাহেনা আক্তারের স্বামীর নামে বাড়ি রেজিস্ট্রীর বিরুদ্ধে মামলা দেয় মা হাসনা আরা বেগম। ফখরুদ্দীন ও তার স্ত্রী-সন্তানদের বিরুদ্ধে সিনিয়র সহকারী জজ, হাতিয়া আদালতে ২৬/২০২২ নং দেওয়ানী মোকদ্দমা শুনানীকালে ফখরুদ্দীনের মৃত্যু হয়।
হাতিয়া সিনিয়র সহকারী জজ আদালতের দেওয়ানী মোকদ্দমা নং ২৬/২০২২ এর ৫ নভেম্বর অন্তর্বর্তীকালীন এক আদেশে বলা হয়- ১ সেপ্টেম্বর বাদীপক্ষ ( ভুক্তভোগীর শ্বাশুড়ি পক্ষ) আদালতে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আবেদন করলে বিবাদীপক্ষের অনুপস্থিতিতে শুনানি করেন আদালত। আদালতের আদেশে বলা হয় বাদীনী হাসনা আরা বেগমকে পূর্বের অবস্থায় বসতবাড়িতে বসবাসের অবস্থান ঠিক করে দেওয়ার জন্য কিন্তু মৃত ফখরুদ্দিনের পরিবারকে উচ্ছেদ করে দেওয়ার কোন নির্দেশনা দেননি আদালত। আদালত স্পষ্ট করে বলেছেন শুধুমাত্র বাদিনী হাসনা আরা বেগমকে তার বসবাসের জন্য পূর্বের অবস্থায় বাসস্থান ফিরিয়ে দিতে।
প্রসঙ্গত, এর আগে বাদিনী হাসনা আরা বেগম ও তার ছেলে বিবাদী মৃত ফখরুদ্দিনের স্ত্রী ও পরিবারসহ একই সাথে একই ঘরে বসবাস করতেন।
অপরদিকে মৃত ফখরুদ্দিনের ক্রয়-কৃত জমির দলিল এখনো আদালত কর্তৃক বাতিল করা হয়নি বা ভুয়া বলে প্রমাণিত হয়নি। সেহেতু এটি একটি অমীমাংসিত বিষয়। তাছাড়া যদি এই ভিটেবাড়ি তাদের পৈত্রিক ভিটে হয় তাহলে মৃত ফখরুদ্দিন তাদের বড় সন্তান হিসেবেও তার অংশীদার।
এদিকে ভুক্তভোগী শাহেনা আক্তারের মেয়ের জামাই মোহাম্মদ বাবুল জানান, আমার শ্বশুর কষ্ট করে বাড়ির জমি কিনছে। আমি এক প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরী করার সুবাদে প্রায়ই চট্টগ্রাম থাকি। অথচ আমার চাচাশ্বশুর ফখরুল ইসলাম পাশা অকারণেই আমাকেও মামলাতে জড়ায়।
এ বিষয়ে বিবাদী পক্ষের ফখরুল ইসলাম পাশার সাথে কথা হলে তিনি প্রতিবেদককে জানান-আমরা অন্যায় ভাবে তাদেরকে ঘর থেকে বাহির করিনি। এটা আদালতের নির্দেশ ছিল।
হাতিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি তৌহিদুল আনোয়ার সময়ের কণ্ঠস্বরকে বলেন, সহকারী কমিশনার ভূমি এর তত্ত্বাবধানে আদালতের নির্দেশনা মোতাবেক তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
এইচএ