প্রতিবন্ধীর মানসম্মান সংরক্ষণ, মানুষ হিসেবে তাদের অধিকার প্রদান এবং তাদের সঙ্গে কোমল আচরণ করার নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। তারা যাতে অবহেলা ও অবজ্ঞার শিকার না হয় এবং সমাজে একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে জীবন যাপন করার অধিকার পায়, সেই ব্যবস্থা করতে বলেছে ইসলাম। শুধু প্রতিবন্ধী নয়, যেকোনো ধরনের অসুস্থ ও অক্ষম ব্যক্তির প্রতি মানবিক ও সহযোগিতাপূর্ণ আচরণ করার নির্দেশ দিয়েছে।
প্রতিবন্ধী বলতে আমরা তাদের বুঝি, যাদের দেহের কোনো অংশ বা তন্ত্র আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে, ক্ষণস্থায়ী বা চিরস্থায়ীভাবে তার স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা হারিয়েছে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, আল্লাহই সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা। তিনি ভালো-মন্দেরও সৃষ্টিকর্তা। কিন্তু তাঁর সৃষ্টিকুলের কিছু অংশকে আমরা অনেক সময় অস্বাভাবিক ও অসুস্থ দেখতে পাই। এর রহস্য ও কল্যাণ আল্লাহ তাআলাই ভালো জানেন।
তবে কেউ কেউ আল্লাহর রহস্য ও কল্যাণের কথা না বুঝেই স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাকে দোষ দেয়; অথচ তিনি সম্পূর্ণ পবিত্র ও দোষমুক্ত। আবার অনেকে সৃষ্টিকেই দোষারোপ করে। যার কোনোটাই উচিত নয়। সৃষ্টিজগতের একাংশকে ত্রুটিপূর্ণ বা অপূর্ণাঙ্গ করার রহস্য আল্লাহই ভালো জানেন।
তবে বিজ্ঞজনেরা এর পেছনে কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেন। তা হলো-
ক. বান্দা যেন আল্লাহর একচ্ছত্র ক্ষমতা সম্পর্কে জানতে পারে এবং বুঝতে পারে যে তিনি সব বিষয়ে ক্ষমতাবান। তিনি যেমন স্বাভাবিক সুন্দর সৃষ্টি করতে সক্ষম, তেমন তিনি এর ব্যতিক্রমও করতে সক্ষম।
খ. আল্লাহ যাকে পূর্ণতা দান করেছেন সে যেন নিজের প্রতি আল্লাহর দয়া ও অনুকম্পাকে স্মরণ করে, অতঃপর তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। কারণ আল্লাহ চাইলে তার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম কিছু করতে পারতেন।
গ. প্রতিবন্ধীকে আল্লাহ তাআলা এই বিপদের বিনিময়ে তাঁর সন্তুষ্টি, দয়া, ক্ষমা ও জান্নাত দিতে চান। নবী (সা.) বলেছেন, ‘আমি যার দুই প্রিয়কে (দুই চোখ) নিয়ে নিই, অতঃপর সে ধৈর্য ধরে এবং নেকির আশা করে, তাহলে আমি তার জন্য এর বিনিময়ে জান্নাত ছাড়া অন্য কিছুতে সন্তুষ্ট হই না।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৪০১)
ড. আবদুল্লাহ নাসেহ ‘উলওয়ান তাকাফুল ইজতিমায়ি ফিল ইসলাম’ কিতাবে বলেন, প্রতিবন্ধীর প্রতি ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি পাশ্চাত্য চিন্তাধারার চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। এসব শারীরিক অক্ষম ও প্রতিবন্ধী রাষ্ট্র, সমাজ ও ধনীদের থেকে সাহায্য-সহযোগিতা, ভালোবাসা ও অনুগ্রহ পাবে। হাদিসে এসেছে, আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ দয়ালুদের ওপর দয়া ও অনুগ্রহ করেন। যারা জমিনে বসবাস করছে তাদের প্রতি তোমরা দয়া করো, তাহলে যিনি আকাশে আছেন, তিনি তোমাদের প্রতি দয়া করবেন। যে লোক দয়ার সম্পর্ক বজায় রাখে, আল্লাহও তার সঙ্গে নিজ সম্পর্ক বজায় রাখেন। যে লোক দয়ার সম্পর্ক ছিন্ন করে, আল্লাহও তার সঙ্গে দয়ার সম্পর্ক ছিন্ন করেন।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১৯২৪)
ইসলামী সমাজে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাও সর্বোচ্চ সম্মান ও মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। তাঁদের অনেকেই বিখ্যাত আলেম ও মুহাদ্দিস ছিলেন; যেমন—ইবনে আব্বাস (রা.) আসিম আল আহওয়াল, আমর ইবনে আখতাব আল আরাজ, আবদুর রহমান আল আসম ও আমাশ প্রমুখ।
নবী (সা.) নিজেও অক্ষম ও প্রতিবন্ধীদের প্রতি সম্মান ও সহমর্মিতা প্রদর্শন করতেন। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘এক নারীর বুদ্ধিতে কিছু ত্রুটি ছিল। সে বলল, হে আল্লাহর রাসুল! আপনার সঙ্গে আমার প্রয়োজন আছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, হে অমুকের মা, তুমি কোনো রাস্তা দেখে নাও, আমি তোমার কাজ করে দেব। তারপর তিনি কোনো পথের মধ্যে তার সঙ্গে দেখা করলে সে তার কাজ সেরে নিল।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৩২৬)
হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা আমার কাছে ওহি পাঠিয়েছেন যে, যে ব্যক্তি ইলম অন্বেষণের রাস্তায় চলবে, আল্লাহ তার জান্নাতের রাস্তা সহজ করে দেবেন। আর আমি (আল্লাহ) যার দুই প্রিয় জিনিস (চোখ) নিয়ে নিয়েছি তার জন্য জান্নাত রেখে দিয়েছি।’ (শুয়াবুল ঈমান লিল বায়হাকি, হাদিস : ৫৩৬৭)
ইসলাম প্রতিবন্ধী, অক্ষম ও দুর্বল ব্যক্তিদের অনেক কঠিন কাজ সহজ করে দিয়েছে এবং তাদের থেকে কষ্ট দূর করার বিধান দিয়েছে। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তিন ব্যক্তি থেকে কলম উঠিয়ে রাখা হয়েছে—ঘুমন্ত ব্যক্তি যতক্ষণ না সে জাগ্রত হয়, নাবালেগ যতক্ষণ না সে বালেগ হয় এবং পাগল যতক্ষণ না সে জ্ঞান ফিরে পায় বা সুস্থ হয়।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২০৪১)
অন্ধ লোককে পথ না দেখিয়ে বিপথগামী করা, তাদেরকে অনর্থক কষ্ট দেওয়া ও উপহাস করা থেকে নবী (সা.) কঠোরভাবে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেন, ‘সেই ব্যক্তি অভিশপ্ত, যে অন্ধকে পথ ভুলিয়ে দিল।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ১৮৭৫)
রাসুলুল্লাহ (সা.) আমর ইবন জামুহ (রা.)-কে সম্মান ও মর্যাদা দিয়ে বলেছিলেন, ‘তোমাদের সর্দার হলো ফরসা ও কোঁকড়ানো চুলবিশিষ্ট আমর ইবনে জামুহ।’ (হিলয়াতুল আউলিয়া : ৭/৩১৭)
আবু কাতাদাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার আমর ইবনে জামুহ (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এসে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমি যদি আল্লাহর পথে জিহাদ করে শহীদ হই, তাহলে জান্নাতে আমি কি সুস্থ ও স্বাভাবিক পায়ে হাঁটতে পারব? তার পা পঙ্গু ছিল। রাসুল (সা.) বললেন, হ্যাঁ। উহুদের যুদ্ধে তিনি, তাঁর এক ভাইয়ের ছেলে ও তাঁদের একজন দাস শহীদ হন। তার কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় রাসুল (সা.) তাকে লক্ষ্য করে বললেন, আমি যেন তোমাকে জান্নাতে সুস্থ ও স্বাভাবিক পায়ে হাঁটতে দেখছি। রাসুল (সা.) তাদের দুজন ও গোলামকে এক কবরে দাফন করার আদেশ দিলেন, ফলে তারা তাদেরকে এক কবরে দাফন করল।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ২২৫৫৩)
আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইবনে উম্মে মাকতুম (রা.) মদিনায় দুইবার তাঁর স্থলাভিষিক্ত করেছেন এবং তিনি অন্ধ হওয়া সত্ত্বেও সালাতের ইমামতি করেছেন। (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ১৩০০০)
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পর মুসলিম খলিফারাও প্রতিবন্ধীদের ব্যাপারে তাঁর পথ অনুসরণ করেন। তাঁরা রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিবন্ধীদের শারীরিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, মানসিক ও তাদের সব ধরনের প্রয়োজন পূরণ করেছেন। খলিফা ওমর ইবনে আবদুল আজিজ (রহ.) সব প্রদেশে ফরমান জারি করেন, সব অন্ধ, অক্ষম, প্লেগ রোগী ও এমন অঙ্গবৈকল্য, যা তাকে সালাতে যেতে বাধা দেয়, তাদের পরিসংখ্যান তৈরির আদেশ দেন। ফলে তারা এসব লোকের তালিকা করে খলিফার কাছে পেশ করলে তিনি প্রত্যেক অন্ধের জন্য একজন সাহায্যকারী নিয়োগ করেন, আর প্রতি দুজন প্রতিবন্ধীর জন্য একজন খাদেম নিযুক্ত করেন, যে তাদের দেখাশোনা ও সেবা করবে।
উমাইয়া খলিফা ওয়ালিদ ইবন আবদুল মালিকও প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে কাজ করেন। তিনি সর্বপ্রথম প্রতিবন্ধীদের দেখাশোনার জন্য বিশেষ ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সেবাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। ৮৮ হিজরি মোতাবেক ৭০৭ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত এসব শিক্ষাকেন্দ্রে ডাক্তার ও সেবক নিয়োগ করেন। প্রতিবন্ধীদের নিয়মিত ভাতা প্রদান করেন। সব অক্ষম, পঙ্গু ও অন্ধের জন্য খাদেম নিযুক্ত করেন।
প্রতিবন্ধী হয়েও ইসলামের ইতিহাসে সম্মান ও খ্যাতি অর্জন করেন বহু মনীষী; যেমন-
১। আবদুল্লাহ ইবনে মাকতুম (রা.)-কে ১৪ বার মদিনার স্থলাভিষিক্ত করেন। অথচ তিনি ছিলেন অন্ধ।
২। হজরত মুয়াজ বিন জাবাল (রা.) পঙ্গু ছিলেন। তাঁকে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইয়েমেনের গভর্নর হিসেবে প্রেরণ করেন।
৩। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) শেষ জীবনে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। তার পরও তিনি কোরআনের শ্রেষ্ঠ ভাষ্যকার ও সমকালের শ্রেষ্ঠ হাদিস বিশারদের মর্যাদা অর্জন করেন।
৪। শ্রেষ্ঠ তাবেয়িদের অন্যতম হজরত আতা (রহ.) কৃষ্ণাঙ্গ, অন্ধ ও বোজা নাকের অধিকারী ছিলেন। শুধু তা-ই নয়, তাঁর হাত ছিল পক্ষাঘাতগ্রস্ত এবং পা ছিল ল্যাংড়া।
৫। আল-আহওয়াল (ট্যারা চোখবিশিষ্ট)। ‘আসিম ইবনে সোলায়মান আল-বসরি (মৃত্যু ১৪২ হিজরি), তিনি হাফিজুল হাদিস ও সিকাহ ছিলেন।
৬। আল-আসাম (সাদা পা-বিশিষ্ট)। হাতিম ইবনে উনওয়ান (মৃত্যু ২৩৭ হিজরি), তিনি আল্লাহভীরুতা, আত্মসংযম ও অনাড়ম্বর জীবনযাপনের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তাঁকে এ উম্মতের লোকমান হাকিম বলা হতো।
এখন আমাদের দায়িত্ব হলো, নিজের সুস্থতার জন্য আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা এবং প্রতিবন্ধী ভাইদের জন্য দোয়া করা। ইসলাম তাদের যেসব অধিকার দিয়েছে তা যথাযথভাবে আদায় করা। যথাসম্ভব প্রতিবন্ধীদের সাহায্য-সহযোগিতা করা। সেটা অন্ধ ব্যক্তিকে রাস্তা চলায় সাহায্য করা হোক কিংবা তাদের জীবনযাপনের ক্ষেত্রে সাহায্য করা হোক কিংবা তাদের শিক্ষাদানে সহযোগিতা হোক। প্রতিবন্ধীর দেখাশোনা করা অভিভাবকের জন্য জরুরি। আর সমষ্টিগতভাবে সব মুসলিমের জন্য ফরজে কিফায়া। অর্থাৎ সমাজের কিছু লোক তাদের দেখাশোনা করলে বাকিরা গুনাহগার হবে না।
এফএস