যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের (রিপ্রেজেনটেটিভ) প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করা হলেও মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। কর্তৃপক্ষের বেধে দেয়া সময়ের বাইরেও তারা হাসপাতালে প্রবেশ করছেন।
হাসপাতালে ঢুকলেই করোনারি ও প্রশাসনিক ভবনের সামনে প্রতিদিনই ফরমাল টাইযুক্ত শার্ট প্যান্ট পরে দাঁড়িয়ে থাকা একদল লোক মানুষের দেখা মিলবে। দেখে হয়তো মনে হবে হাসপাতালের চিকিৎসকরা হয়ত দাঁড়িয়ে কোন কিছু পর্যবেক্ষণ করছেন। কিন্তু পরক্ষণেই জানা যাবে প্রকৃত তথ্য। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে চিকিৎসকের রুম থেকে চিকিৎসাপত্র নিয়ে বের হওয়া রোগী দেখে সাথে সাথেই হুমড়ি খেয়ে পড়েন তারা। রোগীর প্রেসক্রিপশন নিয়ে টানাটানি করে ছবি তুলতে দেখা যাবে তাদের। নাজেহাল হতে হচ্ছে বিপদগ্রস্ত রোগীদের। নিত্যচিত্রের এই তথ্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কানে পৌঁছেছে বহুবার। কিন্তু সেভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এমতাবস্থায় ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা দিনদিন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
এদিকে তাদের যথেচ্ছা হাসপাতালে প্রবেশ করা ঠেকাতে রাউন্ড জোরদার করা হবে বলে জানান হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক।
হাসপাতালের প্রশাসনিক সূত্রে জানা গেছে, চিকিৎসকদের সাথে সাক্ষাতের জন্য সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ রয়েছে সেটা হলো প্রতি সপ্তাহের শনিবার ও মঙ্গলবার দুপর ১টা থেকে ২টা পর্যন্ত তারা চিকিৎসকের সাথে ভিজিট করতে পারবেন। বাকি দিনগুলোতে তারা হাসপাতাল চত্বরে পারবে না। কিন্তু বাস্তবে এই নিয়মের বর্তমানে কোন বালাই নেই। প্রতিদিন সকাল থেকেই তরা হাসপাতালে ভিড় করতে থাকে। তাদের বেপরোয়া কারনে রোগী ও স্বজনেরা বিড়ম্বনায় পড়ছে। কেননা রোগীর ব্যবস্থাপত্র দেয়ার সময় বা ফাঁকে ফাঁকে ওষুধ কোস্পানির প্রতিনিধিরা চিকিৎসকের সাথে লেনদেনে ব্যস্ত থাকে।
অভিযোগ উঠেছে, ওষুধ কোম্পানি ও চিকিৎসকদের শ্রেনী ভেদে নানা উপহার উপঢৌকন মাসিক/বার্ষিক চুক্তিতে রফাদফা হয়ে থাকে। নগদ টাকা, দামি মোবাই ফোন, ল্যাপটপ, এসি, বিভিন্ন সেমিনার খরচ, অনুষ্ঠানের খরচ, পিকনিক, দেশের বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্র ভ্রমনের টিকিট, বিদেশ ভ্রমণের ফ্রি টিকিট দেয়া হয় চিকিৎসকদর। এছাড়াও শাড়ি, তেল, সাবান, শ্যাম্পুসহ নানা প্রসাধনী সামগ্রী উপহার দেয়। ওষুধ কোম্পনীর প্রতিনিধিদের বেপরোয়া কর্মকান্ডে হাসপাতালে আসা রোগী স্বজনরা দুর্ভোগের মধ্যে পড়ে।
সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে হাসপাতালের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক ডা. আবুল কালাম আজাদ লিটু দুর্ভোগের বিষয়টি বিবেচনা করে হাসপাতাল চত্বর থেকে রোগীর ব্যবস্থাপত্রের ছবি তোলা নিষিদ্ধ ঘোষনা করেন। এরপর ওষুধ কোম্পানির প্রতিনধিরা কোনঠাসা হয়ে পড়েন। এক প্রকার রোগীর ব্যবস্থাপত্রের ছবি তোলা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন তারা। কিন্তু বর্তমানে কোন নিয়ম মানছেন না ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা। তারা অবাধে হাসপাতালে প্রবেশ করছেন। রোগীর ব্যবস্থাপত্রের ছবিও তুলছেন।
সরেজমিনে অবস্থান করে দেখা গেছে, শুক্রবার বাদে সপ্তাহের ৬ দিন হাসপাতালের আঙ্গিনায় ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের শতাধিক মোটর সাইকেল জড়ো হতে থাকে সকাল ৮ টা থেকেই। কিছুক্ষণের মধ্যে তারা মোটরসাইকেল রেখে উধাও হয়ে যায়। ওষুধ কোম্পানির কয়েকজন প্রতিনিধি রোগীর বেশে হাসপাতালের বর্হিঃবিভাগ ও অন্তঃবিভাগে প্রবেশ করে। আবার অনেকে প্রকাশ্যে চিকিৎসকের কক্ষে গিয়ে জটলা তৈরি করে। এছাড়া চিকিৎসকের কক্ষের সামনে ও বিভিন্ন কোনে অবস্থান নিয়ে রোগীর ব্যবস্থাপত্রে ছোঁ মেরে কেড়ে নেয়। তারা দেখেন চিকিৎসক তাদের কোম্পানির ওষুধ লিখেছেন কিনা। তারা আবার ব্যবস্থাপত্রের ছবিও তোলেন। তাদের কর্মকান্ডে সব চেয়ে বেশি বিব্রত নারী রোগীরা। ভুক্তভোগীরা এর প্রতিকার দাবি করে বলেন, ওষুধ কোম্পানির আচরণে অনেকেই আতংকিত হন। কারণ অনেক সময় তারা কথা না বলেই ছোঁ মেরে ব্যবস্থাপত্র কেড়ে নেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন রিপ্রেজেনটেটিভ জানান, আমরা এভাবে রোগী বা রোগীর আত্মীয়-স্বজনদের ভোগান্তিতে ফেলতে চাই না। তবে, চিকিৎসক আমাদের কোম্পানির ওষুধ লিখল কিনা সেটা ছবি তুলে না পাঠালে প্রতি মাসিক মিটিংয়ে জবাবদিহি করতে হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওষুধ কোম্পানির কয়েকজন প্রতিনিধি জানান, আমরা এভাবে রোগী বা রোগীর আত্মীয়-স্বজনদের ভোগান্তিতে ফেলতে চাই না। তবে, চাকরি রক্ষার্থে কোম্পানির বেঁধে দেয়া নির্দিষ্ট টাকার ওষুধ বিক্রির টার্গেট পূূরণে মার্কেটিং প্রমোশনের জন্য সময়-অসময়ে হাসপাতালে প্রবেশ করি। নিজ নিজ কোম্পানির ওষুধ লিখতে চিকিৎসকদের নানাভাবে প্রলোভিত করতে হয়। এছাড়াও চিকিৎসক আমাদের কোম্পানির ওষুধ লিখল কিনা সেটা ছবি তুলে না পাঠালে প্রতি মাসিক মিটিংয়ে জবাবদিহি করতে হয়।
অভিযোগ রয়েছে, ওষুধ কোম্পানির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে চিকিৎসকেরা চড়ামূল্যের এন্টিবায়োটিকসহ দামি ওষুধ লিখছে রোগীদের ব্যবস্থাপত্রে। এতে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে রোগীর লোকজন।
হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. হারুন অর রশিদ জানান, ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের অবাধ বিচরণ ঠেকাতে প্রতিনিয়ত হাসপাতাল রাউন্ড দেয়া হয়। তারা হয়তো কর্তৃপক্ষের চোখ আড়াল করে হাসপাতালে থাকছেন। বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখবেন। রোগীর চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত হয়রানী ও দুর্ভোগ লাঘবে সব ধরণের কঠোরতা অবলম্বন করা হবে।