বিভাগীয় ফিল্ড ট্যুর নিয়ে অন্তর কোন্দল নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশবিদ্যালয়ে (নোবিপ্রবি) মৎস্য ও সমুদ্র বিজ্ঞান (ফিমস) বিভাগের শিক্ষক ড. নাহিদ সুলতানা এবং ড. মোঃ মফিজুর রহমান এর মাঝে। শিক্ষার্থীদের জোর করে ট্যুরে যাওয়া এবং না যাওয়ার বিষয়ে পৃথকভাবে আবেদন লিখতে বাধ্য করেন বলে জানা যায়।
এছাড়াও বিভাগের ফিল্ড ট্যুরে না গেলে ঐ কোর্সে শূন্য দেওয়া এবং শিক্ষার্থীদের অনেকের আর্থিক সমস্যা থাকার পরও শিক্ষার্থীদের ট্যুরে যেতে বাধ্য করার অভিযোগ উঠেছে সহকারী অধ্যাপক ড. নাহিদ সুলতানার বিরুদ্ধে।
৮ জানুয়ারি বিভাগীয় চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মেহেদী মাহমুদুল হাসান বরাবর ফিমস বিভাগের ২০২৩-২৪ সেশনের শিক্ষার্থীরা এমন অভিযোগপত্র জমা দেয়।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, ফিশারিজ জুওলজি সেশনাল কোর্সের ফিল্ডট্যুর সম্পন্ন করার লক্ষ্যে আগামী ১১-০১-২০২৫ তারিখে হতে ১৭-০১-২০২৫ তারিখ পর্যন্ত কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি ও সাজেকসহ এর বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানসমূহ পরিদর্শনের জন্য ড. নাহিদ সুলতানা ম্যাম একটি প্রস্তাব করেন এবং এবং শর্ত দেন, যদি আমরা স্থান সমূহে না যাই তাহলে আমাদের কোর্সকোড ফিসম-১১০৪ এ শূন্য নাম্বার দেওয়া হবে। আমাদের আর্থিক সমস্যা থাকার পরও শুধুমাত্র শূন্য পাওয়ার ভীতি থেকে আমরা ট্যুরে যাওয়ার জন্য সম্মতি প্রকাশ করি।
উল্লেখ্য, ট্যুরের ব্যাপারে কোর্সের আরেকজন শিক্ষক সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. মফিজুর রহমান স্যারের সাথে যোগাযোগ করার পর স্যার আমাদের সকলের অর্থনৈতিক দিক বিবেচনা করে একদিনের একটি ট্যুর প্রস্তাব করেন এবং যেতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু ম্যাম ওনার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন ও হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে আমাদের সম্মতি সূচক একটি এপ্লিকেশন লিখে পাঠান এবং আমাদের উক্ত অ্যাপ্লিকেশনে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেন। মূলত ফিমস-১১০৪ এর প্রাকটিকালে শূন্য পাওয়ার ভীতি থেকেই আমরা ম্যামের সাথে ফিল্ডট্যুরে যেতে সম্মতি প্রকাশ করি এবং উক্ত এপ্লিকেশনে স্বাক্ষর করে তা বিভাগের অফিসরুমে তা জমা দেই।
সম্মতি সূচক অন্য আরেকটি অ্যাপ্লিকেশনে শিক্ষার্থীরা বলেন, আমাদের ফিশারিজ জুওলজি সেশনাল কোর্সের ফিল্ড ট্যুর সম্পন্ন করার লক্ষ্যে আগামী ১১ জানুয়ারি থেকে ১৭ জানুয়ারি প্রস্তাবিত তারিখ পর্যন্ত কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি এবং সাজেকসহ এর বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান পরিদর্শনে সর্বসম্মত হই। আমাদের সাথে আমাদের ফিল্ড ট্যুরে যাওয়ার জন্য আমরা আমাদের কোর্সের শিক্ষক ড. মো. মফিজুর রহমান স্যারকে ডিপার্টমেন্টে স্বশরীরে উপস্থিত না পাওয়ায় ফোন মারফত অবগত করি। চার দিনের স্ট্যাডি ট্যুর সম্পন্ন হতে পারে বলে স্যার আমাদের সাথে যেতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন।
এরপর আমরা আমাদের কোর্স টিচার ড. নাহিদ সুলতানা ম্যামকে অনুরোধ করলে উনি আমাদের সাথে স্ট্যাডি ট্যুরে যেতে সম্মত হন। আমাদের অনুরোধে বিভাগের আরেকজন শিক্ষক ড. মো. আনিসুজ্জামান স্যার ও আমাদের সাথে স্ট্যাডি ট্যুরে যেতে সম্মত হয়েছেন। প্রাকটিক্যাল পরীক্ষার পার্ট হিসেবে এই ট্যুরটি আমাদের সকলের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে সুসম্পন্ন হতে যাচ্ছে। এই ট্যুরের জন্য আমাদের বিভাগীয় শিক্ষক অথবা কোর্সের সাথে সম্পৃক্ত কোন শিক্ষক আমাদের জোর জবরদন্তিপূর্বক অংশগ্রহণের জন্য বাধ্য করেননি।
তবে সূত্র জানায়, উক্ত আবেদন পত্রটি ড. নাহিদ সুলতানা নিজে লিখে শিক্ষার্থীদেরকে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে পাঠান এবং শিক্ষার্থীদেরকে বিভাগীয় প্রধান বরাবর জমা দিতে বলেন। এ ছাড়াও অন্য আরেকটি সূত্র হতে জানা যায়, ড. মফিজুর রহমানও শিক্ষার্থীদের চারদিনের ট্যুরের পরিবর্তে একদিনের ট্যুরে যেতে চায় মর্মে জোর করে শিক্ষার্থীদের জোর পূর্বক আরেকটি আবেদনপত্র লিখিয়ে জমা দিতে বলেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ১৯ তম ব্যাচের এক শিক্ষার্থী বলেন, আমার কিছু পারিবারিক সমস্যা থাকায় আমি ট্যুরে যেতে অসম্মতি জানালে আমি অর্গানাইজিং টিমের মাধ্যমে জানতে পারি আমি যদি ট্যুরে অংশগ্রহণ না করি সেক্ষেত্রে ফিমস-১১০৪ কোর্সে ফেল করানো হবে। পরবর্তীতে অর্গানাইজিং টিম আমাকে জানায় যদি আমি ট্যুরের জন্য তিন হাজার টাকা প্রদান করি সেক্ষেত্রে তারা ম্যাডামকে ম্যানেজ করে নিবে এবং তাই বাধ্য হয়ে তিন হাজার টাকা প্রদান করি।
অন্য আরেক শিক্ষার্থী বলেন, আমাকে এবং মেয়ে সি আর নিহাকে মফিজুর রহমান স্যার রুমে আটকে রাখে। এ ব্যাপারে দুইজন সিনিয়র ভাই স্যারের সাথে ছিলো। স্যার আমাদেরকে ধমকও দেন এবং জোরপূর্বক ট্যুরে ম্যামের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র লেখান। ট্যুরের বিষয়ে ম্যাম জোরপূর্বক ট্যুরে নিয়ে যাচ্ছেন এটি মিথ্যা কথা এবং ট্যুরে তিন হাজার টাকা দিলে ম্যাম ফেল করাবেন না এটাও মিথ্যা কথা।
শিক্ষার্থীদের এমন দ্বৈত আচরণ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন উক্ত বিভাগের একজন শিক্ষক। তিনি বলেন, দু'জন শিক্ষক তাদেরকে জোর করে যে দুইটি আবেদন পত্র লিখতে বাধ্য করেছিল এক্ষেত্রে তাদের এক পক্ষে স্ট্রং থাকা উচিত ছিল যেটা তারা চায়। ৫ আগস্টের ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে যে স্বাধীনতা এসেছে সেই অনুযায়ী তাদের উচিত ছিল নিজেদের চাহিদাকে প্রাধান্য দেওয়া। কিন্তু শিক্ষকের জোর করে আবেদন পত্র লিখতে বললে তারা তা লিখতে বাধ্য না। এক্ষেত্রে তাদের দ্বিমুখিতা কোনোভাবেই কাম্য না।
বিভাগীয় সূত্রে জানা যায়, ফিশারিজ জুওলজি-১১০৪ কোর্সটি ড. নাহিদ সুলতানা এবং ড. মো. মফিজুর রহমান এই দুইজন শিক্ষক পড়াচ্ছেন। ট্যুরে এই দুইজন শিক্ষক যাওয়ার কথা থাকলেও ড. নাহিদ সুলতানা এবং বিভাগের অন্য একজন শিক্ষক অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান রিমন গিয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে একই কোর্সের অন্য আরেকজন শিক্ষক (এই কোর্সটি দুইজন শিক্ষক পড়াচ্ছেন) ড. মো. মফিজুর রহমান বলেন, সাধারণত আমাদের ফিল্ডট্যুরগুলো একদিনেরই হয়। আমার কাছে মনে হয়েছে যে এই কোর্সের ফিল্ড ট্যুরের জন্য একদিনই যথেষ্ট, সেশনাল যেগুলো। চারদিনের যাওয়ারতো যৌক্তিকতা নেই। যেখানে যৌক্তিকতা নেই সেখানে আমার যাওয়ারতো প্রশ্নই আসে না। শিক্ষার্থীরা আমার কাছে এসেছিলো। আমি তাদেরকে বলেছি তোমরা যদি একদিনের ট্যুর করতে পারো তাহলে আমি তোমাদের সাথে যেতে আগ্রহী। এরপর আমি আর কিছুই জানিনা। পরবর্তীতে আমি জানতে পারি যে শিক্ষার্থীরা চারদিনের ট্যুরে যাচ্ছে এবং এই ট্যুরের একটি জায়গা সাজেক যেটা আমাদের এই কোর্সের যে কনটেন্ট সেটার সাথে সামঞ্জস্য না। তাই আমি বলেছি তাহলে আমি যাবো না।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র অনুযায়ী, অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান রিমনকে (সাবেক প্রক্টর) গত ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে সকল ধরনের অ্যাকাডেমিক এবং প্রশাসনিক কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার নির্দেশনা দেয়া হয়। কিন্তু গত ৯ জানুয়ারি ২০২৪ উক্ত শিক্ষককে বিভাগী প্রধান অধ্যাপক ড. মেহেদী মাহমুদুল হাসানের সুপারিশক্রমে এই ফিল্ডট্যুরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। এই বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, উক্ত শিক্ষকের নিষেধাজ্ঞা এখনো প্রত্যাহার করা হয়নি।
চার দিনের ফিল্ড ট্যুরের বিষয়ে ড. নাহিদ সুলতানা বলেন, এ ফিল্ড ট্যুর সকল শিক্ষার্থীদের সম্মতিতেই হয়েছে। এ ব্যাপারে আমি কোন জোর করিনি। আউটকাম বেইজড এডুকেশন (ওবিই) কারিকুলামের অংশ হিসেবে শিক্ষার্থীরাই বলেছে সাজেক এবং খাগড়াছড়ি যাবে। সুতরাং, এখানে আমি কাউকেই জোর করিনি। জুলোজি কোর্সের প্রাকটিক্যালের জন্য আমরা কক্সবাজার এসেছি। এরপর ওবিই কারিকুলামের অংশ হিসেবে সাজেক এবং খাগড়াছড়ি যাবো। যেকারনে ৩/৪ দিন লাগছে এ ট্যুর। এ ট্যুরে ড. আনিসুজ্জামান রিমনের সংশ্লিষ্টতা বিষয়ে তিনি বলেন, ট্যুরের জন্য প্রশাসনের সম্মতিপত্র যথাযথ কর্তৃপক্ষের সাইনের মাধ্যমে পাস হয়।
তাছাড়া রিমন স্যার থিসিস এর কাজে ডিপার্টমেন্টে ছিলো। এখন এ ট্যুরওতো একাডেমিকের একটি অংশ। ট্যুরে না গেলে শূন্য দেওয়ার শিক্ষার্থীদের শূন্য দেওয়া হবে এ বিষয়ে তিনে বলেন, ট্যুরে না গেলে ফেল করিয়ে দিবো এটি একটি মিথ্যা কথা। শিক্ষার্থীরা যারা যায়নি তারা মেডিকেল পরীক্ষার্থী। আমরা ১৬ তারিখ ট্যুর থেকে আসবো ১৬ তারিখ এবং ১৭ তারিখ মেডিকেল পরীক্ষা থাকায় অনেকে যেতে পারেনি। তিন হাজার টাকা দিলে ফেল করাবো না এটাও একটা ফেক কথা। তবে, মফিজুর রহমান স্যার ১৯ ব্যাচের দুইজন সিআরকে রুমে আটকে রেখেছিলো। তাদেরকে জোর করে ট্যুরের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ লিখিয়েছে। সেখানে ১৬ ব্যাচের শিক্ষার্থীও স্যারের সাথে ছিলো।
ফিমস বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মেহেদী মাহমুদুল হাসানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, "আনিসুজ্জামান রিমন একাডেমিক কাজে নেই, শুধু ট্যুরে যাওয়ার জন্য যাওয়া। শিক্ষার্থীদের ২টি আবেদনের বিষয়ে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমাদের বিভাগে আলোচনা হচ্ছে। আমি ওভারঅল বিষয়টি দেখতেছি।"
এ বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইসমাইল বলেন, "বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। আমরা খুব শীগ্রই এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিব।"
এবি