দীর্ঘ পাঁচবছরের অধ্যয়ন তপস্যা শেষে অর্জিত হয় কাঙ্ক্ষিত স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী। তবে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) একজন সাধারণ শিক্ষার্থীর নিকট এই সার্টিফিকেট ও নম্বরপত্র অর্জন জ্ঞান সাধনার মাধ্যমে যতটা সহজ ঠিক ততটাই কঠিন এই টেবিল সেই টেবিল ঘুরাঘুরি করে সেসব কাগজপত্র উত্তোলনে। যা রীতিমতো শিক্ষার্থীদের কাছে এক আতঙ্কের নাম যেখানে দীর্ঘদিনের এই অর্জনের আনন্দ নিমিষেই ম্লান হয়ে যায়।
শিক্ষার্থীদের ভোগান্তির আতুড়ঘর খ্যাত পরিক্ষা নিয়ন্ত্রণ দপ্তরে যেন বাসা বেঁধে আছে কতশত সমস্যা। আধুনিক যুগে সনাতন পদ্ধতিতে সার্টিফিকেট উত্তোলন প্রক্রিয়া, দক্ষ জনবল সংকট, শিক্ষার্থী অনুপাতে স্থান সংকুলানে গাদাগাদি যেন নিত্য ঘটনা এখানে এই গুরুত্বপূর্ণ সেবা নিতে আসা শিক্ষার্থীদের কাছে।
সরেজমিনে প্রশাসন ভবনের সার্টিফিকেট প্রদানকারী এই দপ্তর গুলো ঘুরে দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের জন্য নেই কোনো তথ্য কেন্দ্র। কোন কক্ষে গেলে মিলবে কাঙ্ক্ষিত নথিটি তাও জানানোর কেউ নেই। কক্ষে কক্ষে গিয়ে শিক্ষার্থীদেরই ঘুরে ঘুরে জানতে হয় সকল তথ্য। সেই সাথে কাউন্টারে বসে থাকা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছ থেকে পেতে হয় নানা রকমের তিরস্কার যা একজন সাধারণ শিক্ষার্থীর মনকে ভেঙ্গে দেয় এবং যা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি জন্ম দেয় নেতিবাচক ধারনাও।
জানা যায় প্রতিদিন গড়ে শ' খানেক শিক্ষার্থী সার্টিফিকেট ও ট্রান্সক্রিপ্ট তুলতে আসেন প্রশাসন ভবনে। তবে চাকরির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হলে যা প্রায় চারশত থেকে পাঁচশতে গিয়েও দাঁড়ায়। সেই হিসেবে দপ্তরটিতে সার্টিফিকেট উত্তোলনে সহায়তাকারী সংশ্লিষ্ট কর্মচারী মাত্র ৫/৬ জন। সেক্ষেত্রে সার্টিফিকেট উত্তোলন করতে আসা প্রায় সবাইকেই পড়তে হয় কোনো না কোনো হয়রানির মুখে। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের প্রথম এই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার ৪৬তম বর্ষে এসেও হাতেগোনা কয়েকটি ক্ষেত্র ছাড়া আধুনিকতার ছোয়া পায়নি। যার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা অর্জনের চেয়ে কঠিন হয়ে পড়েছে সার্টিফিকেট উত্তোলন।
এছাড়াও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এই কার্যালয়ে থাকা গোপনীয় কক্ষটিও কর্মচারী সংকটে এখন উন্মুক্ত। শিক্ষার্থীদের সেখানে নিজে এসে কাগজ খুজে বের করতে হয়। যার ফলে একজন শিক্ষার্থীর সারাজীবনের ফসল এই সার্টিফিকেটটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের কাছে থেকেও তীব্র অনিরাপত্তায়।
প্রশাসন ভবন সূত্রে, প্রতিটি বিভাগের ফল প্রকাশ, একাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্ট, নম্বরপত্র ও সনদপত্র প্রদানের কাজ করে থাকে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তর। প্রশাসন ভবনের উত্তর ব্লকের তিনতলায় অবস্থিত এই দপ্তরের কাউন্টার ও অফিস কক্ষগুলোতে শিক্ষার্থীদের ভিড় থাকে সব সময়। নিয়মানুযায়ী একজন শিক্ষার্থী এসব কাগজপত্র জরুরি ভিত্তিতে আবেদনের ৫ দিন এবং জরুরি বাদে ১৫ দিনের মধ্যে পাওয়ার কথা। কিন্তু শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, নিয়ম মেনে আবেদনপত্র দেওয়ার পর নির্দিষ্ট সময় কেটে গেলেও কাঙ্ক্ষিত কাগজপত্র মেলে না। অনেক সময় মাসের পর মাস কেটেও যায়। ঘটে আবেদনপত্র হারিয়ে ফেলার মতো ঘটনা। এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কাজের প্রতি অবহেলাকে দায়ী করেন শিক্ষার্থীরা।
এবিষয়ে হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য পদ্ধতি বিভাগের শিক্ষার্থী ফরহাদ হোসেন বলেন, আমাদের পড়াশোনা করার পুরো সময়টায় আমরা যে কষ্ট করি সার্টিফিকেট তুলতে এসেও একি পরিমান কষ্ট। সবচেয়ে বড় বিষয় এখানে অসহযোগিতা। কেউ কাউকে সহযোগিতা করেনা। আমরা যদি কোনো কাগজের জন্য আসি তখন বলে, দেখেন, জানিনা, ব্যস্ত আছি, কাজ করতেছি।
রাফি নামের অপর এক শিক্ষার্থী বলেন, অনেক সময় আমরা জরুরী ভিত্তিতে কাগজ তোলার জন্য টাকা জমা দেই তারপরও আবার আমাদেরই কাউন্টারে কাউন্টারে, গোপনীয় কক্ষে বার বার গিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়।
নিজেদের এমন অপারগতা স্বীকার করে জনবল ও জায়গার সংকটকে দায়ী করেছেন ভারপ্রাপ্ত পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক আবুল কালাম আজাদ। তিনি বলেন, নিচের দিকের কর্মচারী লেভেলের তীব্র সংকট। এমন অবস্থায় পরীক্ষার সময়গুলোতে আবার এখান থেকে কর্মচারী পাঠাতে হয়। যার ফলে আমাদের এই কাজগুলো করতে দারুণ বেগ পেতে হচ্ছে। আমাদের জায়গারও সংকট রয়েছে। যার ফলে আমাদের সার্টিফিকেট রুমে পর্যাপ্ত সিকিউরিটি নাই। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তরের জন্য একটি স্বতন্ত্র জায়গা থাকা বাধ্যতামূলক যেখানে গোপনীয়তা বজায় রাখা যাবে। যা আমাদের এই মুহুর্তে জরুরী প্রয়োজন।
পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এই অফিসটিকে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের হৃৎপিন্ড আখ্যা দিয়ে ধর্মতত্ত্ব অনুষদের ডীন অধ্যাপক ড. আ ব ম সিদ্দিকুর রহমান আশ্রাফি বলেন, এই হৃৎপিন্ডটা যদি ঠিক তবেই বিশ্ববিদ্যালয় ঠিক থাকবে। আমি এই ভোগান্তি দূরীকরনে পরামর্শ দিতে পারি? আমাদের রিসিপ্ট গুলো যেগুলো হারিয়ে যায় তা রক্ষণে ব্যবস্থা নিতে হবে। পর্যাপ্ত কক্ষ থাকাটা এক্ষেত্রে মূখ্য সেইসাথে রুম ও কাউন্টার গুলোতে যদি পয়েন্টিং করে উল্লেখ করে দেয়া হয় কোন কক্ষে কি কাজ সেটিও শিক্ষার্থীদের সমস্যাটা একটু হলেও লাঘব করবে।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নকিব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ বলেন, বিষয়গুলো সম্পর্কে আমি ইতোমধ্যেই অবগত। সার্টিফিকেট উত্তোলনে অটোমেশন সার্ভিস চালু করতে আমাদের একটি কোম্পানির সাথে প্রাথমিকভাবে কথা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের এই ভোগান্তি গুলো শেষ করা প্রয়োজন। বিষয়গুলো নিয়ে আমি আমার শিক্ষকদের কাছ থেকেও অভিযোগ পেয়েছি। কিভাবে এই প্রক্রিয়াটি ওয়ান স্টেপ সার্ভিসের আওতায় আনা যায় তা আমাদের পরিকল্পনায় আছে। অলরেডি প্রভোস্ট কাউন্সিলের মিটিংয়েও বিষয়টি তোলা হয়েছিলো। আশা করা যায় খুব দ্রুতই বিষয়টি সমাধানে আসবে।
এআই