নীলফামারীর সৈয়দপুরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে গত ১৮ জুলাই ছাত্র-জনতার উপর গুলির নির্দেশদাতা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভুমি) ও নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট আমিনুল ইসলাম, সরকার পতনের সাড়ে তিন মাস পেরিয়ে গেলেও আজও সে একই কর্মস্থলে বহাল রয়েছেন।
অভ্যুত্থানের পর গণহত্যার দোসর ও নির্যাতনকারী সরকারী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক কর্মকর্তাকে বদলী ও ওএসডি করা হলেও বিনা প্রয়োজনে পুলিশকে গুলি চালানোর হুকুমদাতা এই কর্মকর্তা এখনও সৈয়দপুরে থাকায় ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। সেই সাথে অন্তবর্তীকালীন সরকার ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কদের ভুমিকা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে ছাত্র-জনতার মাঝে।
স্থানীয় ছাত্র সমন্বয়ক, অভ্যুত্থানের স্বপক্ষের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দসহ সাধারণ মানুষের মাঝে বিরুপ প্রতিক্রিয়া বিরাজ করছে। তাই তারা এবিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানিয়েছেন আন্দোলনে অংশ নেওয়া ছাত্র-জনতা।
প্রত্যক্ষদর্শী অনেকের মতে, গত ১৮ জুলাই ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় শান্তির শহর সৈয়দপুরের সার্বিক পরিবেশ অত্যন্ত শান্ত ও শৃঙ্খলাপূর্ণ ছিল। আন্দোলনকারীরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে তাদের কর্মসূচী পালন করছিল। শহরের প্রাণকেন্দ্র পাঁচমাথা মোড় ও ট্রাফিক পুলিশ বক্স সংলগ্ন ১নং রেলক্রসিং এলাকায় শত শত ছাত্র-জনতা অবস্থান করছিল আর ট্রাফিক বক্সে ছিল উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভুমি) ও নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট আমিনুল হকসহ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সৈয়দপুর সার্কেল) কল্লোল দত্ত, সৈয়দপুর থানার অফিসার ইনচার্জ সাইফুল ইসলাম ও অফিসার ইনচার্জ (তদন্ত) এস এম রাসেল পারভেজসহ রিজার্ভ পুলিশ সদস্যবৃন্দ। সেখানে কোন প্রকার আইন পরিপন্থি কর্মসূচী বা কার্যক্রম ছিলনা। বেলা ২টার দিকে সেদিনের কর্মসূচী প্রায় শেষ পর্যায়ে হঠাৎ করেই পরিবেশকে বেশ স্পর্শকাতর করে তুলে স্বয়ং প্রশাসন।
একজন পুলিশ সদস্য শারীরিক দূর্বলতার জন্য হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে হাসপাতালে নেয়া নিয়ে ছাত্র ও পুলিশের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝির প্রেক্ষিতে একটু বাক বিতন্ডা হয়। এরপর কয়েকজন সমন্বয়ক বিষয়টি তাৎক্ষনিক সুরাহা করে অসুস্থ পুলিশ সদস্যকে হাপাতালে নেয়ার ব্যবস্থা করে দেন। কিন্তু এর কিছুক্ষণ পরই উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভুমি) ও নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট আমিনুল ইসলাম পুলিশকে রেডি হওয়ার নির্দেশ দেন। এতেই পুলিশের কয়েকজন সদস্য শুরু করে সমবেত আন্দোলনকারীদের উপর এলোপাথারী গুলি বর্ষণ। মুহুর্তে গুলির আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন অসংখ্য ছাত্র-জনতা। ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে পুরো সমাবেশ। সড়কে সড়কে ছড়িয়ে পড়ে লোকজন। আশ্রয় নেয় বিভিন্ন দোকানের আড়ালে। কিন্তু অহর্নিশ চলতে থাকে পুলিশের গুলি।
এক পর্যায়ে পুলিশের গুলি শেষ হলে কয়েক সেকেন্ড বিরতি দিয়ে আরেক গ্রুপ পুলিশ আবার শুরু করে গোলাগুলি। এই ফাঁকে ছাত্র-জনতাও শুরু করে ইট-পাথর নিক্ষেপ। এতে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠে। রাস্তায় রাস্তায় আহত গুলিবিদ্ধ মানুষের আহাজারী আর উত্তপ্ত জনতার চিৎকারে ঝঙ্কৃত হয়ে উঠে চারপাশ। খবর ছড়িয়ে পড়ে পুরো শহরে। এতে করে সাধারণ মানুষ, দোকানদার, পাড়া মহল্লা থেকে সকল বয়সের লোকজন ছুটে আসতে থাকে ঘটনাস্থলের দিকে। এতে পরিস্থিতি বেগতিক দেখে গুলিরত পুলিশের প্রহরায় দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন এসিল্যান্ড। তখন ক্ষিপ্ত ছাত্র-জনতা চড়াও হয় পুলিশ বক্সে। এর ফলে পুলিশ সদস্যরা ফায়ার করতে করতে পালিয়ে যায় দিক বিদিক। তারপর সৈয়দপুর থানা থেকে আরও কিছু পুলিশ সদস্য কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে পুরো শহরের সবগুলো রাস্তায় অভিযান চালায়। মোড়ে মোড়ে অবস্থান নেয় রিজার্ভ পুলিশ। এসময়ও কোথাও লোকজন দেখলেই পুলিশ মুহুর্মুহ গুলি বর্ষণ করতে থাকে। মুহুর্তে শান্ত শহর সৈয়দপুর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।
এই অতর্কিত হামলায় ছাত্র-জনতা, পথচারী, দোকানদার, ফেরিওয়ালা, ভিক্ষুকসহ মোট ১৩৮ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। এর মধ্যে ৪৭ জন গুরুত্বর জখম হয়েছেন আর ৮ জন চোখে গুলিবিদ্ধ হওয়ায় দৃষ্টি হারিয়েছেন। পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন বেশ কয়েকজন। এখনও অনেকে চিকিৎসাধীন।
এছাড়াও ১৮ জুলাইয়ের পর থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত আহতদের গ্রেফতার করাসহ বাড়ি বাড়ি তল্লাসীর নামে চালানো হয় হামলা ভাঙ্চুর। আটকের পর থানায় চালানো হয় অকথ্য নির্যাতন। এমনকি নখ তুলে নেয়া ও প্রশ্রাব পান করানোর মত ঘটনাও ঘটিয়েছে পুলিশ। ঘটনার সিসি টিভি ফুটেজ এবং বিভিন্ন মাধ্যমে সংগৃহিত ছবি ও ভিডিও ফুটেজ অনুযায়ী আটকের ভয় দেখিয়ে করা হয় বাণিজ্য। আর এর নেপথ্যে ছিলেন এসিল্যান্ড আমিনুল ইসলাম। অনেক ক্ষেত্রে অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি নিজেই।
এই ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্য দায়ী করে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সৈয়দপুর সার্কেল) কল্লোল দত্ত, থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সাইফুল ইসলাম ও অফিসার ইনচার্জ (তদন্ত) এস এম রাসেল পারভেজ কে বদলী ও ওএসডি করা হয়। কিন্তু পুলিশকে গুলির নির্দেশদাতা এসিল্যান্ড এখনও তার পদে ও কর্মস্থল বহাল রয়েছেন।
কেন, কোন খুটির জোরে তিনি এখনও সৈয়দপুরে দায়িত্ব পালন করছেন? কি কারণে তাঁকে কোন শাস্তির আওতায় আনা হয়নি অথবা ন্যুনতম কোন জবাবদিহিতার আওতায় তাকে নেয়া হলোনা? এসব প্রশ্ন এখন সৈয়দপুরের সর্বস্তরের মানুষের মাঝে। বিশেষ করে আহতরা এব্যাপারে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এবং তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন।
এব্যাপারে পুলিশের গুলিতে ডান চোখ হারানো শিক্ষার্থী শহরের নতুন বাবুপাড়া সাদ্দাম মোড় এলাকার রাহিমুল ইসলাম মাহিন এর পিতা মো. ইউসুফ আলী বলেন, ‘স্বৈরাচার সরকার বিরোধী আন্দোলনে আমার সন্তান অংশগ্রহণ করেছিল। তাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে সহকারী কশিনার (ভুমি) আমিনুল ইসলামের নির্দেশে অমানবিকভাবে গুলি চালিয়েছে পুলিশ। এতে আমার ছেলে অন্ধত্ব বরণ করেছে। আমি এই কর্মকর্তার অপসারণ ও শাস্তি দাবি করছি। এখন কিভাবে সে এখানে কর্মরত আছেন তা সরকার ও সমন্বয়কদের কাছে জানতে চাই।’
উপজেলার খাতামধুপুর ইউনিয়নের দর্জিপাড়ার আলিমুল ইসলাম (৪৫) বলেন, ‘সৈয়দপুরের এসিল্যান্ডের নির্দেশেই পুলিশ ১৮ জুলাই অতর্কিত গুলি করেছিল। আমিসহ অনেকেই সেদিন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। আমার ডান চোখের দৃষ্টি হারিয়েছি। আমার দৃষ্টিশক্তির বিনিময়েই বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠন হয়েছে। অথচ স্বৈরাচারের দোসর সেই সময়ের কর্মকর্তারা আজও বহাল রয়েছে। বিশেষ করে সৈয়দপুরে পুলিশকে গুলির নির্দেশদাতা উপজেলা সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট আমিনুল ইসলাম কি করে এখনও সৈয়দপুরে অবস্থান করছেন তা বুঝে আসেনা। আমরা তার উপযুক্ত শাস্তি দাবি করছি।’
কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক ঢাকা তেজগাঁও কলেজের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র সৈয়দপুরের গোলাহাল রেলওয়ে কলোনীর বাসিন্দা শাহরিয়ার রিফাত সরকার বলেন, সেদিন সরাসরি এসিল্যান্ডের নির্দেশেই পুলিশ আমাদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে অতর্কিত এলোপাথারী গুলি চালিয়েছিল। নিরস্ত্র ছাত্র-জনতা তখন মুহুর্তে রাস্তায় লুটিয়ে পড়েছিল। রক্তাক্ত অবস্থায় শত শত মানুষ হাসপাতালে কান্নার রোল পড়েছিল। আজও অনেকে চোখ হারিয়ে এবং পঙ্গুত্ব বরণ করে চিকিৎসাধীন। এমন একজন গণহত্যাকারী সরকারের দোসরের দ্রুত অপসারণ ও উপযুক্ত শাস্তি চাই। নয়তো তার বিরুদ্ধে মাঠে নামবে ছাত্র-জনতা।
এবিষয় জানতে চাইলে সৈয়দপুর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভুমি) আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘আমি গুলি করার কোন লিখিত নির্দেশ দেইনি। আমার নির্দেশ ছাড়াই পুলিশ গুলি চালিয়ে খুব খারাপ করেছে। কারণ সেখানে গুলি চালানোর মত কোন পরিস্থিতি ছিলনা। আমি নিজেও গুলির মধ্যে জীবন নিয়ে কোন রকমে পালিয়ে এসেছি। একজন ম্যাজিষ্ট্রেট হিসেবে পুলিশকে অপ্রয়োজনে গুলি করা থেকে বিরত না করে কেন স্থান ত্যাগ করেছিলেন? প্রশ্ন করা হলে তিনি কোন উত্তর দিতে পারেননি।’
নীলফামারী জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ নায়িরুজ্জামান বলেন, ‘আমি নতুন এসেছি। সৈয়দপুরের এসিল্যান্ড কর্তৃক ১৮ জুলাই পুলিশকে গুলির নির্দেশ প্রদানের বিষয়ে আমার জানা নেই। জেনে আপনাকে জানানো হবে এবং তদন্ত পুর্বক সত্যতা পাওয়া গেলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে।’