প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষক পরিবারের মেয়ে ফারজানা আক্তার তামান্না। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময় স্বপ্ন দেখেছিল বড় হয়ে ডাক্তার হবেন। সেই স্বপ্ন পূরণে কঠোর পরিশ্রম দিয়ে পড়াশোনা করেছেন তিনি। ২০২৩ সালে এইচএসসি পাস করে অংশ নেন মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায়। কিন্তু সেবার উত্তীর্ণ হয়েও কোন মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পায়নি তামান্না।
মানুষের কটুকথা ও হতাশাকে পেছনে ফেলে ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। এবার সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে ৪৭২৮ তম মেধাতালিকা নিয়ে পটুয়াখালী সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির জন্য মনোনীত হয়েছেন। নিজের স্বপ্ন পূরণের পাশাপাশি দরিদ্র কৃষক পরিবারের মেয়ে তামান্না বাবা মায়ের মুখেও হাসি ফুটিয়েছেন। তার স্বপ্ন একদিন সুচিকিৎসক হয়ে গ্রামের অসহায় মানুষের চিকিৎসা নিশ্চিত করবেন।
গত রোববার (১৯ জানুয়ারি) প্রকাশিত এমবিবিএস প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর তার পরিবার ও আত্মীয় স্বজনরা খুশিতে আত্মহারা। ফারজানা পটুয়াখালী জেলার গলাচিপা উপজেলার গোলখালী ইউনিয়নের বড় গাবুয়া গ্রামের মো. আলাউদ্দিন এবং মিসেস সেলিনা বেগমের ছোট মেয়ে। বাবা একজন কৃষক এবং মা গৃহিণী। তার একজন বড় বোন রয়েছেন তিনি বিএ পাস করেছেন।
শিক্ষাজীবনের শুরু ফারজানার হরিদেবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। সেখান থেকে ২০১৫ সালে পিএসসিতে জিপিএ ৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। পরে গলাচিপা বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ২০১৮ সালে জেএসসি ও ২০২১ সালে এসএসসিতে জিপিএ ৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। এাবার নিজ উপজেলা ছেড়ে ভর্তি হন বরিশাল সরকারি মহিলা কলেজে। সেখানে ২০২৩ সালে এইচএসসি পাস করেন জিপিএ ৪.৯২ পেয়ে। পাস করার পর প্রথমবার ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ভর্তির সুযোগ না পেলে ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের এম.বি.বি.এস. ভর্তি পরীক্ষায় দ্বিতীয়বার অংশগ্রহণ করে টেস্ট স্কোর ৭৮ ও মেরিট স্কোর ১৭৪.২ নম্বর অর্জন করে পটুয়াখালী সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শিক্ষাজীবনে ধারাবাহিক মেধা এবং কঠোর পরিশ্রম তাকে এই অসামান্য সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে। তার গ্রামের আশেপাশের কোন গ্রামে মেডিকেল পড়া কোন শিক্ষার্থী নাই। ছোটবেলায় থেকে পড়াশোনার প্রতি ছিল মনোযোগী। তার মেধার কৃতিত্ব রেখেছেন সর্বত্র। দরিদ্র কৃষক বাবা মো. আলাউদ্দিন কষ্ট করে টাকা লোন করে, জমিজমা বিক্রি করে মেয়ের পড়াশোনা করিয়েছেন। সবসময় তার ইচ্ছে ছিল শত কষ্টের মধ্যে মেয়েদের পড়াশোনা চালিয়ে নিবেন। তাই আজ লোনের টাকা পরিষদের জন্য ঢাকায় একটি পোশাক কারখানায় চাকরি নিতে হয়েছে তাকে। তবুও মেয়ের এমন সাফল্য খুশি তিনি। তার কষ্ট ও শ্রম আজ সার্থক বলে মনে করছেন। তবে ভর্তি ও পরবর্তী পড়াশোনা চালিয়ে নিতে দুশ্চিন্তাও রয়েছে তার।
ফারজানার বাবা মো. আলাউদ্দিন বলেন, আমার মেয়ে আজ আমাদের মুখ উজ্জ্বল করেছে। আমরা গর্বিত এবং আশা করি সে একদিন দেশের একজন সেরা চিকিৎসক হয়ে মানুষের সেবা করবে। আমার এতদিনের পরিশ্রম আজ সার্থক। আমার আবাদি জমি মেয়েদের পড়াশোনার খরচ চালাতে গিয়ে বিক্রি করতে হয়েছে। এখন বিক্রি করার মত কোন জমি নেই। তাছাড়া আমি এখন ধার দেনা ও ঋণে জর্জরিত। সামনে মেয়ের ভর্তি ও পড়াশুনার খরচ চালিয়ে নিতে এবং মেয়েকে ডাক্তার বানানোর স্বপ্ন পূরণে আর্থিক সহযোগিতা প্রয়োজন।
ফারজানা তার সাফল্যের জন্য বাবা-মা,শিক্ষকদের এবং সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, গতবার ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে যখন চান্স পায়নি তখন হতাশায় ভেঙে পড়ি। মানুষের বিভিন্ন কটুকথা শুনতে হয়েছে আমাকে ও আমার পরিবারের সবাইকে। আমার বাবা মা সবসময় কষ্ট করে আমার পড়াশোনা করিয়েছেন। আমার পড়াশোনা চালিয়ে নিতে জমিজমা বিক্রি করতে হয়েছে। কোচিং করেও যখন প্রথমবার চান্স হয়নি এই ব্যর্থতা আমাকে খুব কষ্ট দিয়েছে। পরে বরিশালের আমার কলেজের এক সিনিয়র বড় বোন তামান্না বেগম ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী। তার কাছে নতুন করে স্বপ্ন দেখার অনুপ্রেরণা পাই। তার দেয়া দিকনির্দেশনা ও পরামর্শ অনুযায়ী কোচিং ছাড়াই ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় আবার অংশগ্রহণ করি। পরীক্ষার পরপরই মনে হয়েছে আমি চান্স পাবো। ফলাফল দেখার পর আমি খুশিতে কান্না করে দিয়েছি।
ফারজানা আরও বলেন, আমার গ্রামের আশেপাশের কোন গ্রামে মেডিকেল পড়া শিক্ষার্থী নাই। তাই আমি চাই একজন সুচিকিৎসক হয়ে গ্রামে ফিরে আসবো। আমার গ্রামের মানুষের চিকিৎসা নিশ্চিত করবো। এখানকার দরিদ্র মানুষেরা চিকিৎসার জন্য খুবই কষ্ট করে। আমি আমার স্বপ্ন পূরণে তাই পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ প্রাধান্য তালিকা রেখেছিলাম।
তিনি আরোও বলেন, দরিদ্র পরিবারের সন্তান হয়ে পড়াশোনা চালিয়ে নিতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। এবছর অর্থাভাবে কোচি করতে করতে পারি নাই। কলেজের সিনিয়র বোন তামান্নার পরামর্শ ও অনলাইনে বিভিন্ন গাইডলাইন ফলো করে পড়াশোনা করেছি। সকল কিছুতে আমার শিক্ষকরা সহযোগিতা করেছেন। তাছাড়া উপবৃত্তির টাকা দিয়ে আমার পড়াশোনা চালিয়ে নিয়েছি। আমি আমার শিক্ষক, বোন ও পরিবারের প্রতি অনেক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
এদিকে তার সাফল্যে এলাকাবাসীর মধ্যে আনন্দের জোয়ার বইছে এবং সবাই তার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য দোয়া করেছেন। স্থানীয়রা মনে করেন, ফারজানার এই অসাধারণ সাফল্য প্রমাণ করে, কঠোর পরিশ্রম এবং সঠিক দিকনির্দেশনা থাকলে প্রতিকূলতাকে জয় করা সম্ভব।
গলাচিপা বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আলমগীর হোসেন বলেন, ফারজানা আমাদের বিদ্যালয়ের গর্ব। তার ধারাবাহিক মেধা এবং কঠোর পরিশ্রম সকল শিক্ষার্থীর জন্য অনুপ্রেরণা।
এমআর