সারাদেশে যখন মেডিকেল এসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুল (ম্যাটস) এর শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে ব্যস্ত। ঠিক সেই সময় মানিকগঞ্জে দেখা মিলল এক ভুতুড়ে সরকারি মেডিকেল এসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুলের। যেখানে বড় বড় ভবন থাকলেও নেই শিক্ষার সুব্যবস্থা। ফলে চরম ভোগান্তিতে দিন কাটছে শিক্ষার্থীদের।
মঙ্গলবার (২১ জানুয়ারি) সকালে মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া মেডিকেল এসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুল (ম্যাটস) এমন দৃশ্য দেখা যায়।
অফিস সুত্রমতে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানটির আসন সংখ্যা ৩২টি হলেও ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে প্রথম ব্যাচে ২৬ জন ছাত্রছাত্রী ভর্তি করে অনানুষ্ঠানিক ভাবে ক্লাস শুরু করে। সেই সময়, জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে ৪ জন খণ্ডকালীন মেডিকেল অফিসার নিয়োগ দেওয়া হয় ক্লাস পরিচালনার জন্য। তবে তারা কেউই যোগদান করে নি।
অপরদিকে, প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজের গাইনি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. ওসমান গনিকে। বর্তমানে এই অধ্যক্ষই একমাত্র ভরসা। অথচ এই অধ্যক্ষই আসেন প্রতি বৃহস্পতিবার।
বর্তমানে ২০২২-২৩ এবং ২০২৩ -২৪ সালের ভর্তি কৃত দুই ব্যাচের শিক্ষার্থীদের নিয়ে শিক্ষাক্রম চলমান রয়েছে। অপর দিকে ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি চলছে। এমন অবস্থা যদি চলতে থাকে তাহলে এই ভুতড়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে কেউ শিক্ষা নিয়ে বের হতে পারবে না। বরং অপচিকিৎসা শিকার হবে দেশের জনগন। স্বাস্থ্য শিক্ষার মত জরুরী শিক্ষা কার্যক্রম যদি এভাবে খুড়িয়ে চলে। তাহলে কি শিক্ষা পাবে এই কোমলমতি শিক্ষার্থীরা ।
নামমাত্র কয়েকটি বই থাকলেও নেই লাইব্রেরি, নেই মেডিকেলের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, নেই মানব দেহের কঙ্কাল, নেই মানব দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বাস্তব সচিত্র দেখার সুযোগ, নেই সুসজ্জিত ল্যাবরেটরি । তাই দিন দিন এক অন্ধকার জগতের দিকে যাচ্ছে এই প্রতিষ্ঠানটি।
প্রথম বর্ষের ছাত্রী মুক্তা আক্তার বলেন, আমি টাঙ্গাইল থেকে এখানে ভর্তি হয়েছি। অনেক স্বপ্ন আশা নিয়ে আসছি যে পড়াশোনা শেষ করে একজন ভাল মেডিকেল এসিস্ট্যান্ট বা সহকারী ডাক্তার হবো কিন্তু এখানে এসে প্রতিটা দিন চরম অনিশ্চিতায় ভুগছি। ভবিষ্যতে কি করবো তাই নিয়ে চিন্তা সব সময়।
প্রথম বর্ষের ছাত্রী রিতু বলেন, আমি ছাত্রী হোস্টেলে থাকি। তবে এখানে নেই কোনো নিরাপত্তা প্রহরী। হোস্টেলের পানিতে প্রচুর আইরন, সেই বিশুদ্ধ পানির সুব্যবস্থা। তাই পানি কিনে খেতে হয়। ক্যান্টিন থাকলেও আমাদের রান্না করে খেতে হয়। আমাদের নিরাপত্তা আমাদেরই করতে হচ্ছে। যা একেবারেই অসম্ভব। সবসময় ভয় নিয়ে রাত কাটে।
১ম বর্ষের শিক্ষার্থী মাশরাফি বলেন, বর্তমানে আন্দোলনের জন্য আমাদের ক্লাস বন্ধ রয়েছে। তবে আমাদের প্রতিদিন ৪টি ক্লাস হওয়ার কথা থাকলেও শিক্ষক সংকটে তা হয় না। এখানে চরম নিরাপত্তাহীনতা ও উৎকণ্ঠায় ভুগছি।
শিক্ষার্থী নাজমুল হাসান বলেন, আমাদের এখানে বড় বড় ভবন আছে, ক্লাস রুম আছে কিন্তু বসার জন্য যথাযথ আসবাবপত্র নেই। সেই সাথে নেই শিক্ষক ও জনবল। আমাদের প্রিন্সিপাল স্যার এনাটমি ক্লাস নেন, তিনি একমাত্র ভরসা। অন্য কোন পার্মানেন্ট শিক্ষক নেই। কি শিখব তা নিয়ে হতাশা সারাক্ষণ।
কুমিল্লা থেকে আসা শিক্ষার্থী ফয়েজ ইসলাম বলেন, এত দূর থেকে এখানে পড়াশোনা করতে আসছি কিন্তু এসে বিপাকে পরে গেছি। এভাবে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চলতে পারে না। পুরো প্রতিষ্ঠানে একজন অস্থায়ী নিরাপত্তা গার্ড। যা দিয়ে এত বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা কীভাবে দেবে। প্রায় সময় বহিরাগতরা ভেতরে প্রবেশ করে ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করে। ছাত্রী হোস্টেলের পেছনের রাস্তায় বখাটেরা মেয়েদের বাজে মন্তব্য করে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন মানিকগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম বিশ্বাস বলেন, সরকারের কিছু বাধ্যবাধকতা থাকতেই পারে । তবে এটি স্বাস্থ্য শিক্ষার বিষয় তাই অতিদ্রুত সব সমস্যা চিহ্নিত করে কর্তৃপক্ষের যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া উচিত।
এ বিষয়ে অধ্যক্ষ ডা. মো. ওসমান গনি বলেন, এখানে কোনো বাজেট নেই। ফলে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। যাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছিল তারা আসে নাই। তাই খণ্ডকালীন শিক্ষক দিয়ে ক্লাস করানো হচ্ছে। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বার বার জনবল ও বাজেট চেয়ে চিঠি দিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা নেয়নি অধিদপ্তর।
উল্লেখ, শিক্ষার্থীদের ক্লাস নেয়ার জন্য ডা. রাসেল হোসেন, ডা. নুসরাত জাহান মৌরিন ও ডা. সালসাবিল অরর্চিকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল । কিন্তু ডা. রাসেল হোসেন নিয়োগ দেয়ার পর এখানে যোগদান করেননি। ডা. নুসরাত জাহান মৌরিন যোগদান করে দু’বছরের জন্য শিক্ষাকালীন ছুটি কাটাচ্ছেন। ডা. সালসাবির হোসেন অরর্চি তিনি যোগদান করেই বিদেশ চলে গেছেন।
আওয়ামী লীগের শাসন আমলের সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও মানিকগঞ্জ ৩ আসনের সংসদ সদস্য জাহিদ মালেক তার নিজ জেলায় বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পে সরকারের কোটি কোটি টাকা খরচ করে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেছে স্বাস্থ্য শিক্ষাকে এগিয়ে নিতে। কিন্তু জনবল সংকট ও বাজেট এবং শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা না থাকায় দিন দিন বড় বড় সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে এই প্রতিষ্ঠান গুলোকে।
এমআর