দেশে গবাদিপশুর অন্যতম পরিচিত রোগ হলো ব্রুসেলোসিস। ব্রুসেলা অ্যাবর্টাস (Brucella abortus) নামক এক ধরনের ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে এ রোগ হয়। এই জীবাণুতে গবাদিপশু আক্রান্ত হলে গর্ভপাত হয়, দুধ উৎপাদন কমে যায় এবং অনেক ক্ষেত্রে বন্ধ্যাত্ব দেখা দেয়। যার ফলে আক্রান্ত প্রাণীর জন্য খামারিদের বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। এ ছাড়া এই জীবাণুটি জুনোটিক হওয়ায় প্রাণী থেকে মানুষের দেহে ছড়াতে পারে। যার মানবস্বাস্থ্যের ঝুঁকিও রয়েছে। তাই আক্রান্ত পশুকে জবাই করে মাটিতে পুঁতে ফেলা বা পুড়িয়ে ফেলার পরামর্শ দিয়েছে বিশ্ব প্রাণী স্বাস্থ্য সংস্থা ।
তবে আশার কথা হলো, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) একদল গবেষক দেশে প্রথমবারের মতো ব্রুসেলা অ্যাবর্টাস বায়োভার-৩ জীবাণুটি পৃথকীকরণ এবং এর জেনেটিক বৈশিষ্ট্য উন্মোচন করতে সক্ষম হয়েছেন। এটি ভবিষ্যতে এ রোগ নিয়ে আরও উচ্চতর গবেষণা ও দ্রুত শনাক্তকরণে বড় ভূমিকা রাখবে বলে দাবি গবেষকদের।
শুধু জীবাণু পৃথকীকরণেই থেমে থাকেননি বাকৃবি গবেষক দল । তারা প্রথমবারের মতো ইনএক্টিভেটেড (নিষ্ক্রিয় জীবাণু) ব্রুসেলা ভ্যাকসিন উদ্ভাবন করেছেন। এই ভ্যাকসিনটি গবাদিপশুর প্রজনন সক্ষম সময় একবার প্রয়োগ করলে ৬ মাস পর্যন্ত সুরক্ষা দিতে পারে । বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত এই ভ্যাকসিন প্রয়োগে প্রতি পশুতে সর্বোচ্চ ৫০ টাকা খরচ হবে। তবে সরকারি তত্ত্বাবধানে ব্যাপক উৎপাদন শুরু হলে তখন এটি খামারিরা নামমাত্র দামে পাবেন বলে দাবি গবেষকদের।
এই গবেষণার প্রধান ছিলেন বাকৃবির ভেটেরিনারি অনুষদের মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড হাইজিন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আরিফুল ইসলাম। সহকারী গবেষক হিসেবে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ও পিএইচডি শিক্ষার্থী মো. জামিনুর রহমান এবং বাকৃবির মাইক্রোবায়োলজি এন্ড হাইজিন বিভাগের অধ্যাপক ড মোছাঃ মিনারা খাতুন কাজ করেছেন।
২০১৬ সাল থেকে অধ্যাপক ড. আরিফুল ইসলাম ব্রুসেলা জীবাণু নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। দীর্ঘ গবেষণার পর ২০১৮ সালে দেশে বিদ্যমান ব্রুসেলা অ্যাবর্টাস বায়োবার-৩ এর উপস্থিতি প্রথমবার শনাক্ত করেন। পরবর্তী তিনি জীবাণুটি মলিকুলার পদ্ধতিতে শনাক্তকরণ এবং এর জিনগত বৈশিষ্ট্য উন্মোচন করেন। এ কাজে ইতালি ও যুক্তরাজ্যের গবেষকরাও সহযোগিতা করেছেন। যা একটি কার্যকর একটি নিষ্ক্রিয় ভ্যাকসিন তৈরির পথ আরও সহজ করেছে ।
বাংলাদেশ একাডেমি অব সাইন্সেস-ইউনাইটেড স্টেটস ডিপার্টমেন্ট অফ এগ্রিকালচার (বিএএস-ইউএসডিএ) এর অর্থায়নে গবেষণাটি সম্পন্ন হয়েছে।
জানা গেছে, এই ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য ল্যাবের সাদা ইঁদুর এবং গাভীর উপর প্রয়োগ করা হয় । ইদুরগুলোর ক্ষেত্রে দেখা গেছে ব্রুসেলা ভ্যাকসিন প্রয়োগকৃত প্রাণীগুলোকে নিয়মিত ব্রুসেলা জীবাণু দ্বারা সংক্রামিত করা হলেও কোন উপসর্গ দেখা যায়নি। অন্যদিকে ল্যাবের যেসব ইদুরে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়নি তাদের ক্ষেত্রে ব্রুসেলোসিসের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। এ ছাড়া মাঠে এই রোগটির কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য ময়মনসিংহ, গাজীপুর ও টাঙ্গাইলের ৪০০ গাভীর দেহে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়। পরবর্তী এসব গাভীর রক্তের এন্টিবডি পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষায় দেখা গেছে, ব্রুসেলোসিস রোগটি প্রতিরোধের জন্য যে মাত্রায় দেহে এন্টিবডি প্রয়োজন তার চেয়ে অধিক মাত্রায় তৈরী হয়েছে।
ভ্যাকসিনের চাহিদা সম্পর্কে জানতে চাইলে অধ্যাপক আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘বর্তমানে দেশে ব্রুসেলোসিসের কোনো ভ্যাকসিন নেই। ভারতে ভ্যাকসিন পাওয়া গেলেও সেটি লাইভ অ্যাটেনুয়েটেড (দুর্বল জীবাণু)। যার পাশ্বপ্রতিক্রিয়া পশুতে গর্ভপাত ঘটাতে পারে এবং দুর্ঘটনাবশত মানুষের দেহে প্রবেশ করলে মানবদেহেও সংক্রমণ ঘটাতে পারে। এ ছাড়া এটি সর্বদা ঠান্ডা (৪°C) অবস্থায় রাখতে হয়, নইলে কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু বাকৃবির উদ্ভাবিত নিষ্ক্রিয় অণুজীব ভ্যাকসিনে সাধারণ তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা যায়। এ ছাড়া এটি প্রয়োগের ফলে স্বাস্থ্য ঝুকি এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কোন সম্ভাবনাও নেই। তাছাড়া দেশের আর্থসামজিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এই ভ্যাকসিন বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে কার্যকর হবে।’
অধ্যাপক আরিফুল ইসলাম আরও বলেন, ‘জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা, পশুর উৎপাদন বৃদ্ধি ও জুনোটিক ঝুঁকি প্রতিরোধের এই তিন দিক বিবেচনা করেই এই জীবাণুর উপর গবেষণা ও ভ্যাকসিন উদ্ভাবন করা হয়েছে। অনেকেই অজ্ঞাতবশত আক্রান্ত পশুর সংস্পর্শে এসে সংক্রমিত হন। ফলে আনডুল্যান্ট ফিভার, যকৃত ও পুরুষের প্রজনন অঙ্গে প্রদাহ এবং নারীর ক্ষেত্রে গর্ভপাত পর্যন্ত ঘটতে পারে। তবে নির্দিষ্ট সময়ে সমস্ত খামারের গাভীকে ভ্যাকসিন প্রদান এবং যথাযথ বায়োসিকিউরিটি নিশ্চিত করলে সহজেই এ রোগ থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব।’
ইখা