বরগুনার আমতলী উপজেলার ছোট্ট উপকূলীয় গ্রাম চুনাখালী একসময় পরিচিত ছিল ‘নৌকার গ্রাম’ নামে। চারপাশে নদী-খাল ঘেরা এই গ্রামে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তৈরি হতো হাজারো কাঠের নৌকা। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ব্যবহৃত মাছ ধরার নৌকা, যাত্রীবাহী নৌকা, পণ্য পরিবহনের বড় বড় কাঠের বোট সবই প্রস্তুত হতো এখানকার দক্ষ কারিগরদের হাতে। কিন্তু নৌকা তৈরির সেই ঐতিহ্য আজ বিলুপ্তির পথে।
চুনাখালীর ৯ শতাধিক পরিবারের মধ্যে শতাধিক পরিবার বংশপরম্পরায় এ পেশায় যুক্ত ছিল। প্রায় দুই শতাব্দী ধরে এই গ্রাম ধরে রেখেছিল কাঠের নৌকা তৈরির নাম-খ্যাতি। বছরে কোটি টাকারও বেশি মূল্যের নৌকা বিক্রি করতেন এখানকার কারিগররা। কিন্তু কাঠের দাম বৃদ্ধি, আর্থিক সংকট এবং আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাবে এখন ভেঙে পড়ছে সেই পুরনো ঐতিহ্য।
একসময় গ্রামে ঢুকলেই কানে আসত ঠকঠক শব্দ কাঠে হাতুড়ির আঘাত, করাতের শব্দ, আর সেইসঙ্গে কারিগরদের প্রাণচাঞ্চল্য। সূর্য ওঠার আগেই শুরু হতো কাজ, সন্ধ্যা পর্যন্ত চলত ব্যস্ততা। এখন সেই দৃশ্য আর দেখা যায় না। নৌকা কারিগররা কাজের অভাবে দিশেহারা।
গ্রামের বয়স্করা জানান, আট-দশ বছর আগেও শতাধিক পরিবার নৌকা তৈরির পেশায় সক্রিয় ছিল। বর্তমানে সেই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১৪-১৫ পরিবারে। বাকিরা জীবিকার টানে অন্যান্য পেশায় পাড়ি দিয়েছেন।
৬৫ বছর বয়সী প্রবীণ কারিগর আব্দুল জলিল বলেন, “আগে বছরের অর্ধেক সময় ব্যস্ততায় কাটত। এখন মাসের পর মাস কাজ নেই। কাঠের দাম বাড়ছে, মানুষের হাতে টাকা নেই অর্ডারও আসে না।
স্থানীয় সূত্র জানায়, আগে বছরে কোটি টাকার বেশি মূল্যের নৌকা তৈরি হতো চুনাখালীতে। এখন তা অর্ধেকেও নেমেছে। নৌকা কারিগর মোজাম্মেল মাদবর বলেন, “কাঠ, লোহা আর রঙ-টারকোলের দাম এত বেড়েছে যে খরচই ওঠে না। বিক্রিও আগের মতো নেই। অনেকেই এনজিওর চড়া সুদের ঋণে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হন।
চাম্বল, মেহগনি, রেইনট্রি, কড়ইসহ নৌকা তৈরিতে ব্যবহৃত কাঠের দাম গত পাঁচ বছরে দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। কাঠের সংকট, শ্রমিক মজুরি বৃদ্ধিসহ রঙ-টারকোলের দাম বেড়ে যাওয়ায় কারিগরদের খরচ বাড়ছে, লাভ কমছে। সেগুন, গামার কাঠ এখন আর আগের মতো পাওয়া যায় না।
গ্রামের তরুণ প্রজন্ম নৌকা তৈরির পেশায় আগ্রহ হারাচ্ছে। তারা বলছে, এই পেশায় টিকে থাকা কঠিন। তরুণ সোহাগ হাওলাদার বলেন, “বাবা-দাদারা এই পেশায় সংসার চালিয়েছেন। এখন নৌকা বানালে লাভ হয় না, উল্টো ধার করতে হয়।
গ্রামে কাঠের নৌকার বাজার কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ ইঞ্জিনচালিত ট্রলার ও ফাইবার বোটের জনপ্রিয়তা। দ্রুতগামী হওয়ায় অনেকেই সেগুলোর দিকে ঝুঁকছেন। ফলে হাতে তৈরি কাঠের নৌকা বাজারে টিকে থাকতে পারছে না।
চুনাখালী ও আশপাশের নদীগুলোর অনেক অংশ ভরাট হয়ে গেছে। খনন না হওয়ায় নৌকা চলাচল কমে গেছে, মাছ ধরা কমেছে যা কাঠের নৌকার চাহিদা আরও কমিয়ে দিচ্ছে।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা মনে করেন, সরকারি সহায়তা এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা গেলে এই ঐতিহ্য আবারও ঘুরে দাঁড়াতে পারে। তাদের দাবি, চুনাখালীর নৌকা শিল্পকে ‘স্থানীয় হস্তশিল্প’ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হলে নতুন করে সম্ভাবনা তৈরি হবে।
চুনাখালীর নৌকা শুধু একটি ব্যবসা নয় এটি একটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, এক টুকরো গ্রামীণ ইতিহাস। সেই ঐতিহ্য আজ হারিয়ে যাওয়ার পথে। সময় থাকতে উদ্যোগ না নিলে হারিয়ে যাবে দুই শতাব্দীর গর্ব।
এসআর