চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল লাইন ঘেঁষে সবুজের জমি। সেই সবুজের বুকে পড়ছে একের এক ভেকুর কোপ; কেটে নিয়ে যাচ্ছে উর্বর মাটি। এমন দৃশ্যের দেখা মিললো কক্সবাজারের রামু উপজেলার পশ্চিম উমখালী এলাকায়। স্থানীয়রা জানান, প্রতিবছর ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত চলে আবাদি জমির টপ সয়েল কাটার হিড়িক।
তাদের অভিযোগ, কয়েক বছর ধরে কৃষিজমি সুরক্ষা আইনের তোয়াক্কা না করে ফসলি জমিসহ খাস জমির মাটি বিক্রির স্থানীয় ভূমিদ্যসু দিদার বলী ও তার সাঙ্গ-পাঙ্গরা ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে উঠছে। তারা ফসলি জমি ও বাঁকখালী নদী থেকে বালু-মাটি কেটে ইটভাটায় বিক্রি করছে। দক্ষিণ মিঠাছড়ির উমখালী গ্রামের নদীর পাড়সহ রেললাইনের পাশের অন্ততপক্ষে ৫টি স্থানে দিন রাত সমানতালে মাটি লুট করা হচ্ছে। জমির কয়েকজন মালিকদের অল্প কিছু টাকা দিয়ে জোরজবরদস্তি করে মাটি কাটা হচ্ছে। প্রতিবাদ করলে মারধর ও হয়রানির শিকার হচ্ছে গ্রামবাসী। এভাবেই ফসলি জমিসহ রেল লাইনের পাড় কেটে বিক্রি করে গত কয়েক বছরে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন মাটি খেকু একটু চক্র।
রাজারকুল-মিঠাছড়ি সড়কের চলাচলকারী পথচারীরা এমন অবস্থায় পড়ে। ধরপাড়া এলাকার পশ্চিমের বিলে ২ টি, গণি সওদাগর পাড়া বিলে ২ টি, রাজারকুল ১ নং ওয়ার্ড মৌলভী পাড়া বিলে ১টি, ৪ নং ওয়ার্ড পূর্ব উমখালী ফল্লানের বিলে ১ টি স্কেবেটর দিয়ে দিন রাত সমান তালে ফসলী জমির মাটি কাটছে দিদার বলী নামের একজন।
মিঠাছড়ির প্রায় সাত বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে চলছে তাদের লুটতরাজ। দিনে অন্তত ৬ শত গাড়ি মাটি বিক্রি করছেন তারা। যার আনুমানিক মূল্য ৬০ হাজার টাকা। এদিকে তাদের কারণে নিঃস্ব হয়েছে অসংখ্য মানুষ। স্থানীয়রা বলছে, মাটি লুট চক্রের সঙ্গে প্রশাসনেরও চলে চোর-পুলিশ খেলা। মাঝে মাঝে অভিযান হয়। কিছুদিন পর যে কে সেই। এভাবেই চলছে বছরের পর বছর। এমন অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
সরেজমি দেখা যায়, বসতভিটার কিছু দূরেই ফসলি জমি। পাশেই বাঁকখালী নাদী। নদীর দু’পাড়ের মাঠে সবজির সমারোহ। চাষ করা হয়েছে ধান, বেগুন, মরিচ, মুলা, শাকসহ বিভিন্ন জাতের সবজি। এসব ক্ষেতের পাশেই অনেক জমি ৮/১০ ফুট নিচু। সেখান থেকে স্কেবেটর (খননযন্ত্র) দিয়ে মাটি কেটে নেওয়া হচ্ছে ইটভাটা ও বিভিন্ন স্থাপনা ভরাটের কাজে। এই চিত্র রামুর চাকমারকুল ইউনিয়নের কলঘর বাজারের এন আলম ফিলিং ষ্টেশনের সামনে ফুয়ারচর এলাকার।
স্থানীয়রা বলছেন, জোরপূর্বক ফসলি জমি থেকে গভীরভাবে খনন করে মাটি ও বালু উত্তোলন করায় আশপাশের জমি ভেঙে পড়ছে। কৃষকরা সব সময় আতঙ্কে থাকেন কখন কার জমি ভেঙে পাশের গর্তে পড়ে।
স্থানীয় কৃষকদের অভিযোগ, সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের সাথে মোটা অংকের মাসোয়ারা ভিত্তিক চুক্তিতে বছরের পর বছর বিস্তীর্ণ ফসলি জমির বুকে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে আসছেন স্থানীয় জিয়াবুল ও তার ছেলে জামশেদ। তারা ওই এলাকার ফসলি জমির শত্রুর হয়ে উঠেছেন।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, সব মহলকে ম্যানেজ করেই ফসলি জমি থেকে মাটি-বালু উত্তোলন করা হচ্ছে বলে জোর প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন জামশেদ। তাই ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পাচ্ছেন না। তারা এব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের জরুরি হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, ফসলি জমির বুক চিরে ছুটছে বড় বড় ট্রাক। লক্ষ্য বাঁকখালীর তীর ও জমি থেকে কাটা মাটি ইট ভাটা এবং বিভিন্ন স্থাপনার কাজে নিয়ে যাওয়া। সামান্য অদূরেই চলছে বিস্তীর্ণ ফসলি জমির মাঝ খান থেকে অত্যাধুনিক স্কেবেটর দিয়ে জমির মাটি কাটার কর্মযজ্ঞ। সে মাটি সংগ্রহে ব্যস্ত অসংখ্য ডাম্পারও। যেই জমির উপরিভাগে সবজী এবং ধান বুনা হতো সে জমিতে এখন বিশাল আকারের গর্ত। ওই গ্রামের চারপাশ ঘুরে দেখা যায় এ এক অন্যরকম কর্মব্যস্ততা। এভাবেই কলঘর বাজারের পশ্চিম পাশের ফুয়ারচর এলাকার বাঁকখালীর তীরসহ বিপুল পরিমাণ ফসলি জমির বালু ও মাটি যাচ্ছে ইটভাটার পেটে। এতে করে ওই জমিগুলো যেমন উর্বরতা হারাচ্ছে তেমনি ধ্বংস হচ্ছে এসব ফসলি জমি। পরিবেশ অধিদপ্তর আইন লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললেও বাস্তবে ফসলি জমি ধ্বংসের মহোৎসব হরহামেশাই চোখে পড়ছে।
পশ্চিম উমখালীর পূর্ব ধরপাড়ায় মাটি কাটার ছবি তুলতে গেলে এক যুবক বাধা দেন। তিনি বলেন, এলাকায় ছবি তোলা, ভিডিও করা নিষেধ। এসব করলে ঝামেলা হবে। এর মধ্যে সংবাদকর্মী দেখে এলাকার ৮–১০ জন কৃষক জড়ো হন। প্রকাশ করেন নিজেদের অসহায়ত্ব। তারা বলেন, দক্ষিণ মিঠাছড়ি ইউনিয়নের উমখালাী এলাকায় গত ৪ থেকে ৫ বছর ধরে দিদার বলীসহ একটি চক্র জোর করে মাটি কেটে বিক্রি করে দিচ্ছেন।
এ সময় কথা হয় স্থানীয় বাসিন্দা করিম, সোলাইমান আলীসহ একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে। তারা বলেন, ফসলি জমির প্রথমে মাটি কাটা হলো। এখন স্কেবেটর দিয়ে রেল লাইনের পাশের বেড়িবাঁধসহ নদীর পাড়ের মাটি কাটা হচ্ছে। ফলে জমির তলদেশ ফাঁকা হয়ে যাওয়ায় আমাদের আশপাশের জমিগুলো হুমকির মুখে পড়েছে। এছাড়া মাটি-বালু পরিবহনের কাজে ভারি যান (ডাম্পার-ট্রাক) চলাচলের কারণে ধুলো পড়ে পুরো মাঠের ফসলসহ বাড়ি-ঘর নষ্ট হয়ে গেছে।
নাম ও পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক উমখালী এলাকার নদী তীরবর্তী বাসিন্দারা জানান, প্রভাবশালী মাটি ও বালু ব্যবসায়ী দিদার বলীকে অনুরোধ করা সত্ত্বেও বালু ও মাটি কাটা অব্যাহত রেখেছেন। সারা রাত ট্রাকে করে মাটি ও বালু পরিবহন করায় গ্রামীণ সড়কগুলো ধসে চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। আবার রেল লাইনের পাশের জমি থেকে মাটি কাটার কারণে রেল লাইনসহ তীরবর্তী বাড়িঘর হুমকির মুখে পড়েছে।
তারা আরও বলেন, প্রভাবশালী বালু ও মাটি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে স্থানীয় প্রশাসন এবং জনপ্রতিনিধিদের কাছে অভিযোগ করে প্রতিকার মেলেনি। মাঝে মাঝে প্রশাসন থেকে অভিযান চালিয়ে ভেকুর ব্যাটারীসহ ড্রেজার মেশিনপত্র জব্দ করা হলেও কিছুদিন পর আবার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যায়। এ অবস্থা বিরাজ করলে আগামী দু’তিন বছরের মধ্যে নদীর পাশের ফসলি জমি, ভিটে ও বাড়িঘর ধসে নদগর্ভে বিলীন হবে।
অন্যদিকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চাকমারকুল ইউনিয়নের স্থানীয় জিয়াবুল সওদাগর ও তার ছেলে জামশেদ গত ৬/৭ বছর ধরে বালু-মাটি কাটছেন। শুধু তাই নয়, নদীর তীর থেকে এক্সকেভেটর দিয়ে মাটি কেটে ডাম্পার যোগে ইটভাটাসহ বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করছেন। নির্বিচারে চলছে ফসলি জমির উপর অত্যাচার। এমনকি এই ভূমিদস্যু নিজের সুবিধার জন্য সরকারি খাস জমির মাটিও বিক্রি করে যাচ্ছে সমান তালে। এ যেন স্বেচ্ছাচারিতার রাজত্ব। এতে একদিকে যেমন ফসলি জমির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে, অন্যদিকে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব এবং ঘরবাড়ি, নদীর বেড়িবাঁধ হুমকিতে পড়েছে। স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় কেউ তাদের এই অপকর্মে বাধা দিতে সাহস পাচ্ছে না তাদের। ওই এলাকায় দেশী অস্ত্রসহ দাড়িয়ে রাখা হয় কয়েকজন যুবককে। তারা কাটার কর্মযজ্ঞ পাহাড়া দেয়। কেউ ছবি কিংবা ভিডিও করতে চাইলে করা হয় নির্মম নির্যাতন।
একই গ্রামের ভুক্তভোগী শামশুল আলম বলেন, খননযন্ত্র দিয়ে ফসলি জমি, নদীর পাড়ের মাটি কেটে বড় বড় ট্রাক দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। প্রশাসন মাঝেমধ্যে লোক দেখানো অভিযান করলেও কজের কাজ কিছুই হয় না। নামমাত্র কিছু জরিমানা করলেও পরদিন থেকে আবার চলে তাদের মাটি কাটা।
স্থানীয় কৃষক হারুন উর রশিদ বলেন, কৃষকদের বাঁধা উপেক্ষা করে এই ভূমিদস্যু পিতা-পুত্র কৃষি জমি, নদীরপাড়, বেড়িবাঁধের মাটি অবাধে কেটে নিচ্ছে। এতে করে ধুলা বালিতে আশপাশের শত শত একর ফসলি জমির ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে এক সময় খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে।
ওই এলাকায় সাড়ে চার একর জমির মালিক কৃষক আলি হোসেন (ছন্মনাম)। জমিতে ফসল ফলানোই তার একমাত্র আয়ের পথ। চাষবাস করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। মাটি কেটে নেওয়ায় গত কয়েক মৌসুমে ফসল আবাদ করতে পারছেন না তিনি।
হতাশা প্রকাশ করে আলি হোসেন আরও বলেন, আমাদের না জানিয়ে জমির মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ গণ্যমান্য ব্যাক্তিদের নিয়ে বাধা দিতে এসেছিলাম। তারা টাকা খেয়ে চুপ করে চলে গেছেন। প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি—সবাই টাকার কাছে জিম্মি হয়ে গেছে।
এব্যাপারে অভিযুক্ত জামশেদ মাটি কাটার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, কিছু আগে প্রশাসন অভিযান চালানোর পর থেকে মাটি কাটা হচ্ছে না। সবকিছু আপাতত গুটিয়ে রাখা হলেও স্কেবেটরটি ওখান থেকে সরিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন বলেন, এইসব অবৈধ মাটি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ইউএনও-এসিল্যান্ডকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
এমআর