বনী ইসরাঈলের সর্বশেষ নবী হজরত ঈসা আ.। তিনি বিশ্ববাসীর জন্য হজরত মুহাম্মদ সা.-এর আগমনের সুসংবাদ দিয়ে গেছেন। আল্লাহ তা’আলা জীবিত অবস্থায়
তাকে আসমানে উঠিয়ে নিয়েছেন। ইহুদীরা তাকে হত্যা করতে পারেনি। কিয়ামতের পূর্ব মুহূর্তে তিনি আমাদের নবীর উম্মাত হয়ে আবারও দুনিয়াতে আগমণ করবেন এবং খোদাদ্রোহী অবিশ্বাসী দাজ্জালকে ধ্বংস করবেন, খ্রিস্টান ধর্মের পতন ঘটাবেন, ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন, আমাদের নবীর শরীয়ত দ্বারা বিচার-ফয়সালা করবেন এবং ইসলামের বিলুপ্ত হওয়া আদর্শগুলো পুনর্জীবিত করবেন।
তার আগমন ও দাজ্জালকে ধ্বংসের বিষয়টিকে হাদিসে কিয়ামতের অন্যতম বড় আলামত হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। একাধিক হাদিসে বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে।
এক হাদিসে হজরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেন—
"যার হাতে আমার প্রাণ তাঁর শপথ, অচিরেই তোমাদের মাঝে মরিয়মের পুত্র ন্যায়পরায়ণ শাসক হিসেবে অবতরণ করবেন। তিনি ক্রুশ ভাঙবেন, শূকর বধ করবেন, জিযিয়া তুলে দিবেন এবং সম্পদের প্রাচুর্য দেখা দেবে। এমনকি কেউ সম্পদ গ্রহণ করবে না, এমনকি একটি সাজদার মূল্য দুনিয়া ও তার সব সম্পদের চেয়ে বেশি বলে গণ্য হবে"। (বুখারি, হাদিস : ২/৭৭৪)
অন্য হাদিসে আবু হুরায়রা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন,
"নবীগণ বৈমাত্রেয় ভাইদের মত; তাঁদের মাতৃগণ পৃথক হলেও তাঁদের দীন একই। মরিয়মের পুত্র ঈসার বিষয়ে আমারই অধিকার বেশি; কারণ তাঁর ও আমার মাঝে কোনো নবী নেই। তিনি অবতরণ করবেন। যখন তোমরা তাঁকে দেখবে তাঁকে চিনবে: তিনি মধ্যমাকৃতির লালচে-শুভ্র মানুষ। তাঁর পরিধানে হালকা হলুদ রঙের দুটি কাপড় থাকবে। (পরিচ্ছন্নতার কারণে) তাঁর মাথায় পানি স্পর্শ না করলেও মনে হয় যে তা থেকে পানি পড়ছে। তিনি ক্রুশ ভাঙবেন, শূকর বধ করবেন, জিযিয়া অপসারণ করবেন, সকল মানুষকে ইসলামের দিকে ডাকবেন। তাঁর সময়ে ইসলাম ছাড়া অন্য সকল ধর্ম বিলুপ্ত হবে। তাঁর সময়েই মাসীহ দাজ্জালকে আল্লাহ ধ্বংস করবেন।
এরপর পৃথিবীতে শান্তি-নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হবে। এমনকি উটের সাথে সিংহ, গরুর সাথে বাঘ ও মেষের সাথে চিতা চরবে। শিশুরা সাপ নিয়ে খেলবে কিন্তু সাপ তাদের ক্ষতি করবে না। তিনি চল্লিশ বৎসর অবস্থান করবেন। এরপর তিনি মৃত্যুবরণ করবেন এবং মুসলিমগণ তাঁর জানাযা আদায় করবে"। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ২/৪০৬)
হজরত ঈসা আ. পৃথিবীতে নির্দিষ্ট সময় অবস্থান করার পর তিনি মৃত্যু বরণ করবেন। মুসলমানগণ তার জানাযা নামায পড়ে তাকে দাফন করবেন। তাঁর আগমণের পক্ষে কুরআন ও সহীহ হাদীছে অনেক দলীল রয়েছে। নিম্নে কতিপয় দলীল বর্ণনা করা হলোঃ
কুরআন থেকে দলীলঃ
আল্লাহ তাআলা বলেন,
‘‘এবং তারা বলে আমরা মারইয়ামের পুত্র আল্লাহর রাসূল ঈসাকে হত্যা করেছি। মূলতঃ তারা তাঁকে হত্যা করতে পারেনি এবং ক্রুশবিদ্ধও করতে পারেনি; বরং তাদেরকে সন্দেহে ফেলা হয়েছে। নিশ্চয়ই যারা তাতে মতবিরোধ করেছিল তারাই সে বিষয়ে সন্দেহে রয়েছে। কল্পনার অনুসরণ ব্যতীত এ বিষয়ে তাদের কোন জ্ঞান নেই। প্রকৃতপক্ষে তারা তাঁকে হত্যা করতে পারেনি। আল্লাহ তাঁকে নিজের দিকে উঠিয়ে নিয়েছেন। আল্লাহ পরাক্রান্ত, মহাজ্ঞানী। আহলে কিতাবদের প্রত্যেকেই তাঁর মৃত্যুর পূর্বে তাঁর প্রতি ঈমান আনয়ন করবে এবং উত্থান দিবসে তিনি তাদের উপর সাক্ষ্য প্রদান করবেন"। (সূরা নিসাঃ ১৫৭-১৫৯)
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,
‘‘নিশ্চয়ই ঈসা (আঃ) কিয়ামতের নিদর্শন। সুতরাং তোমরা কিয়ামতের ব্যাপারে কোন প্রকার সন্দেহ পোষণ করোনা। আমার অনুসরণ করো। এটাই সরল পথ’’। (সূরা যুখরুফঃ ৬১)
"অত্র আয়াতে কিয়ামতের পূর্বে ঈসা (আঃ)এর আগমণের কথা বলা হয়েছে। এটি হবে কিয়ামতের একটি বড় আলামত। তাঁর আগমণ কিয়ামত নিকটবর্তী হওয়ার প্রমাণ বহন করবে’’
ঈসা (আঃ) কোথায় এবং কখন অবতরণ করবেন?
ঈসা (আঃ) এর আগমণ, কিয়ামত নিকটবর্তী হওয়ার একটি বড় আলামত। পূর্বে আলোচনা করেছি যে, দাজ্জালের ফিতনা থেকে মুসলমানদেরকে মুক্ত করার জন্য তিনি আগমণ করবেন। এটিই হবে তাঁর প্রথম ও প্রধান কাজ। সে হিসেবে আখেরী যামানায় দাজ্জাল আগমণ করে যখন মুসলমানদের ঈমান নষ্ট করার কাজে আত্মনিয়োগ করবে এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে তখন ঈসা (আঃ) আগমণ করে দাজ্জালকে হত্যা করবেন।
ঈসা ইবনে মারইয়াম (আঃ) আকাশ থেকে অবতরণের পূর্ব মুহূর্তে মুসলমানগণ দাজ্জালের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্ত্ততি গ্রহণ করতে থাকবে। এমতাবস্থায় ফজরের নামাযের ইকামত হয়ে যাবে। তখন মুসলমানদের ইমাম নামাযের ইমামতির জন্য সামনে চলে যাবেন। ঈসা (আঃ)কে দেখে মুসলমানদের ইমাম পিছনে চলে আসতে চাইবেন এবং ঈসা (আঃ)কে ইমামতি করতে বলবেন। কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে মুক্তাদী হয়ে নামায পড়বেন।
নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
"সে (দাজ্জাল) যখন মুসলমানদের ঈমান ধ্বংসের কাজে লিপ্ত থাকবে আল্লাহ তাআলা তখন ঈসা ইবনে মারিয়াম (আঃ)কে পাঠাবেন। জাফরানের রঙ্গিন দু’টি পোষক পরিহিত হয়ে এবং দু’জন ফেরেশতার পাখার উপর হাত রেখে দামেস্ক শহরের পূর্বে অবস্থিত সাদা মিনারের উপরে তিনি অবতরণ করবেন। তিনি যখন মাথা নিচু করবেন তখন সদ্য গোসলখানা থেকে বেরিয়ে আসা ব্যক্তির মাথা থেকে যেভাবে পানি ঝরতে থাকে সেভাবে তাঁর মাথা থেকে পানির ফোটা ঝরতে থাকবে এবং যখন মাথা উঁচু করবেন তখন অনুরূপভাবে তাঁর মাথা হতে মণি-মুক্তার মত চকচকে পানির ফোটা ঝরতে থাকবে। কাফেরের শরীরে তাঁর নিঃশ্বাস পড়ার সাথে সাথেই কাফের মৃত্যু বরণ করবে। চোখের দৃষ্টিসীমা পর্যন্ত গিয়ে তাঁর নিঃশ্বাস শেষ হবে।
তিনি দাজ্জালকে ফিলিস্তীনের লুদ্দ শহরের গেইটে পাকড়াও করে হত্যা করবেন। অতঃপর তাঁর নিকট এমন কিছু লোক আসবেন যাদেরকে আল্লাহ তাআলা দাজ্জালের ফিতনা হতে হেফাযত করেছেন। তিনি তাদের চেহারায় হাত বুলাবেন এবং বেহেশতের মধ্যে তাদের উচ্চ মর্যাদা সম্পর্কে সংবাদ দিবেন"।
নবী কারিম (সা.) বলেন,
"মুসলমানগণ দাজ্জালের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যে প্রস্ত্ততি গ্রহণ করতে থাকবে এবং কাতারবন্দী হতে থাকবে। ইতিমধ্যেই যখন নামাযের ইকামত হয়ে যাবে তখন ঈসা (আঃ) অবতরন করবেন। আল্লাহর শত্রু দাজ্জাল ঈসা (আঃ)কে দেখেই পানিতে লবণ গলার ন্যায় গলতে থাকবে। ঈসা (আঃ) যদি তাকে ছেড়েও দেন তথাপিও সে মৃত্যু পর্যন্ত গলতে থাকবে। কিন্তু তিনি তাকে নিজ হাতে হত্যা করবেন এবং মুসলমানদেরকে তাঁর লৌহাস্ত্রে দাজ্জাল হত্যার আলামত হিসেবে রক্ত দেখাবেন"।
ইয়াজুয-মাজুযকে যেভাবে ধ্বংস করবেন
ইয়াজুয-মাজুযের আগমণ কিয়ামতের একটি অন্যতম বড় আলামত। এ ব্যাপারে একটু পরে বিস্তারিত আলোচনা হবে। এখানে যা বলা প্রয়োজন তা হলো দাজ্জালের ফিতনা খতম করার পর ইয়াজুয-মাজুযের দলেরা পৃথিবীতে নতুন করে মহা বিপর্যয় সৃষ্টি করবে। এই বাহিনীর মোকাবেলা করা মুসলমানদের জন্য অসম্ভব হয়ে পড়বে। তাই ঈসা (আঃ) আল্লাহর কাছে এই বাহিনীকে ধ্বংস করার জন্য প্রাণ খুলে দু’আ করবেন। আল্লাহ তাআলা তাঁর দু’আ কবূল করবেন এবং ইয়াজুয-মাজুযের বাহিনীকে সমূলে খতম করে দিবেন।
ঈসা (আঃ) পৃথিবীতে কত দিন থাকবেনঃ
ঈসা (আঃ) পৃথিবীতে কত দিন থাকবেন এ ব্যাপারে দুই ধরণের মত পাওয়া যায়। কোন কোন বর্ণনায় আছে তিনি সাত বছর অবস্থান করবেন। আবার কোন বর্ণনায় আছে চলিলশ বছরের কথা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
‘‘অতঃপর তিনি চল্লিশ বছর পৃথিবীতে অবস্থান করে মৃত্যু বরণ করবেন। মুসলমানেরা তাঁর জানাযা নামায পড়ে দাফন করবে।[১৩] মুসলিম শরীফে আছে
‘‘অতঃপর মানুষেরা পৃথিবীতে সাত বছর শান্তিতে বসাবাস করবে। পরস্পরের মধ্যে কোন প্রকার হিংসা-বিদ্বেষ থাকবেনা’’
ঈসা (আঃ) এর মৃত্যু বরণ এবং দাফনঃ
তিনি কোথায় মৃত্যু বরণ করবেন- এব্যাপারে কোন সুস্পষ্ট দলীল পাওয়া যায়না। তদুপরি কোন কোন আলেম বলেনঃ তিনি মদ্বীনায় ইন্তেকাল করবেন এবং মদ্বীনাতেই রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর সাথে তাঁকে দাফন করা হবে। ইমাম করতুবী বলেনঃ তাঁর কবর কোথায় হবে- এ ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন বায়তুল মাকদিসে আবার কেউ বলেছেনঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে মদ্বীনায় তাঁর কবর হবে।