বলা যায় ২০২৪ সাল ছিল হাফেজদের জন্য বিশ্ব জয়ের এক অনন্য বছর। বিশ্বজুড়ে আয়োজিত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের হাফেজগণ নিজেদের মেধা ও প্রতিভার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। মক্কা থেকে কায়রো, তুরস্ক থেকে ইরান ও সেনেগাল-- প্রতিটি প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশি হাফেজদের অংশগ্রহণ এবং বিজয় আমাদের গৌরবের মাত্রা বাড়িয়েছে বহুগুণ।
এ বছর ৬জন বাংলাদেশি হাফেজ বিশ্বমঞ্চে নিজেদের দক্ষতা ও কোরআনের প্রতি গভীর নিষ্ঠার প্রমাণ দিয়ে শীর্ষস্থান অর্জন করেছেন।
আসুন, জেনে নেই; ২০২৪ সালে আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় বিজয়ী সেই ৬ হাফেজের অবিস্মরণীয় সাফল্যের গল্প।
তুরস্কে প্রথম মুয়াজ মাহমুদ: তুরস্কে অনুষ্ঠিত নবম আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অর্জন করেন হাফেজ মুয়াজ মাহমুদ। তিনি রাজধানী ঢাকার মিরপুর-১ এ অবস্থিত মারকাযু ফয়জিল কোরআন আল ইসলামীর ছাত্র।
বুধবার (৩০ অক্টোবর) তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের হাত থেকে ক্রেস্ট ও আর্থিক পুরস্কার গ্রহণ করেন মুয়াজ মাহমুদ।
এছাড়া, চলতি বছরের বুধবার (২১ আগস্ট) মক্কায় ৪৪তম আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় ১২৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম স্থান অর্জন করে। সে সময় হাফেজ মুয়াজ মাহমুদ ১৫ পারা গ্রুপে প্রথম স্থান অর্জন করেন।
আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অর্জন করায় হাফেজ মুয়াজকে ছাদখোলা বাসে সংবর্ধনা দেয় সাধারণ জনতা। ২০১৬ সালের পর তুরস্কের এ প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে বাংলাদেশ।
মক্কায় ৩য় সালেহ আহমদ তাকরিম: আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় ১১১ দেশের মধ্যে ৩য় হয় বাংলাদেশের তাকরিম। আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় আবারও দেশের নাম উজ্জ্বল করেন কিশোর হাফেজ সালেহ আহমদ তাকরিম।
মক্কার পবিত্র মসজিদুল হারামে ঘোষণা করা হয় সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের নাম। যেখানে ৫টি শাখায় ১১১টি দেশের ১৫৩ জন প্রতিযোগী অংশ নেন। প্রতিটি শাখায় ৩ জন করে মোট ১৫ জনকে পুরস্কৃত করা হয়েছে।
প্রতিযোগিতার চতুর্থ শাখায় (শুদ্ধ উচ্চারণসহ ১৫ পারা কোরআন মুখস্থ) তৃতীয় হয়েছেন বাংলাদেশের সালেহ আহমেদ তাকরিম।
চতুর্থ শাখায় তৃতীয় অবস্থান অর্জন করায় তাকরিমের হাতে তুলে দেয়া হয় ১ লাখ রিয়াল মূল্যমানের পুরস্কার, বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ দাঁড়ায় অন্তত সাড়ে ২৭ লাখ টাকা। এ ছাড়া তার হাতে সনদ ও সম্মাননা ক্রেস্ট তুলে দেন অতিথিরা।
সৌদির বাদশাহ আবদুল আজিজের নামে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতা মুসলিম বিশ্বের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ একটি প্রতিযোগিতা।
পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজের উপদেষ্টা ও মক্কা নগরীর গভর্নর খালেদ আল ফয়সাল বিন আবদুল আজিজ; সৌদি আরবের ইসলাম ও দাওয়াহবিষয়ক মন্ত্রী আবদুল লতিফ বিন আবদুল আজিজ আলে শেখসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে, গত মার্চে ইরান আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় সালেহ আহমাদ তাকরীম প্রথম এবং মে মাসে লিবিয়ায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় সপ্তম স্থান অর্জন করে।
তার গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের নাগরপুর থানার ভাদ্রা গ্রামে। তার বাবা হাফেজ আবদুর রহমান একটি মাদ্রাসার শিক্ষক, মা গৃহিণী। সে ঢাকার মারকাযু ফয়জিল কোরআন আল ইসলামি মাদ্রাসার শিক্ষার্থী।
সেনেগালে প্রথম আবু রায়হান: সেনেগালে ১১তম আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতা-২০২৪ এর আসরে প্রথম স্থান অর্জন করেছেন বাংলাদেশি হাফেজ আবু রায়হান। সোমবার (৮ এপ্রিল) আন্তর্জাতিক ক্বিরাত সংস্থা বাংলাদেশ এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানায়।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ‘সেনেগালের রাজধানী ডাকারে অনুষ্ঠিত ১১তম বিশ্ব কোরআন প্রতিযোগিতা-২০২৪ এর আসরে বিশ্বের উল্লেখযোগ্য ২৮টি দেশের প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করে। সেনেগালের স্থানীয় সময় রোববার রাত ১০টায় পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা করা হয়। এতে প্রথম স্থান অর্জন করে বাংলাদেশ, দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে মিশর এবং তৃতীয় স্থান অর্জন করে সেনেগাল। প্রথম পুরস্কার জয়ী বাংলাদেশি হাফেজ আবু রায়হান পান ২০ হাজার মার্কিন ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ২১ লাখ ২৯ হাজার টাকা), দ্বিতীয় পুরস্কার ১০ হাজার মার্কিন ডলার, তৃতীয় পুরস্কার তিন হাজার ডলার।’
‘শিশু কারি’ হিসেবে খ্যাতি পাওয়া হাফেজ আবু রায়হান ২০১৮ সালে কাতারে অনুষ্ঠিত টেলিভিশন ভিত্তিক রিয়েলিটিশো তিজানুন নূর তথা জিম টিভিতে আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অর্জন করেছিলেন।
ইরানে প্রথম বশির আহমেদ: ইরানে অনুষ্ঠিত শিক্ষার্থীদের জন্য আয়োজিত অষ্টম আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছে বাংলাদেশি হাফেজ বশির আহমেদ।
চলতি সপ্তাহে ইরানের শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং আওকাফ ও দাতব্য বিষয়ক সংস্থা যৌথভাবে এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে। ইরানের ৪০তম আন্তর্জাতিক পবিত্র কোরআন প্রতিযোগিতার সঙ্গে মিল রেখে একযোগে শিক্ষার্থীদের জন্য এই আয়োজন করা হয়।
প্রতিযোগিতায় কোরআন তেলাওয়াত ও হিফজ, অর্থাৎ সম্পূর্ণ কোরআন মুখস্থ করার পৃথক দুটি বিভাগে অংশগ্রহণ করে ছেলে ও মেয়েরা।
হাফেজ বশির আহমদ ঢাকার মারকাজুত তাহফিজ ইন্টারন্যাশনাল মাদ্রাসার ছাত্র। তার বাড়ি হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার বেগুনাই গ্রামে। তার বাবা সহকারী অধ্যাপক মাওলানা মো. আবদুর রশিদ।
কুয়েতে প্রথম আনাস মাহফুজ: কুয়েতে অনুষ্ঠিত ১৩তম আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছেন বাংলাদেশের হাফেজ আনাস মাহফুজ। ৮ থেকে ১২ বছরের ছিগারুল হুফফাজ (শিশু হাফেজদের গ্রুপ) গ্রুপে প্রথম স্থান অর্জন করেন তিনি। আনাস মাহফুজ রাজধানীর মিরপুরের মারকাযু ফয়জিল কুরআন আল ইসলামির শিক্ষার্থী।
মঙ্গলবার (১৯ নভেম্বর) স্থানীয় সময় বাদ মাগরিব ফলাফল ঘোষণা করা হয়। এতে কোরআন প্রতিযোগিতায় প্রথম হিসেবে হাফেজ আনাসের নাম ঘোষণা করা হয়।
কুয়েতের ক্রাউন প্লাজায় তিনটি ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপে অনুষ্ঠিত হয়েছে এ প্রতিযোগিতা। ছোট গ্রুপ থেকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন হাফেজ আনাস মাহফুজ। তার গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলায়। এর আগে তিনি জাতীয় হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতা ২০২৩ পিএইচপি কোরআনের আলোয় তৃতীয় স্থান অধিকার করেন।
মক্কায় প্রথম আনাস বিন আতিক: মক্কায় ৪৪তম আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় ১২৩টি দেশের মধ্যে ৩০ পারা গ্রুপে প্রথমস্থান অর্জন করেছে হাফেজ আনাস বিন আতিক।
বুধবার (২১ আগস্ট) রাতে সৌদি আরবে মক্কায় এশার নামাজের পর পবিত্র হারাম শরীফের ভিতর ৪৪তম আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়।
ফাইনাল রাউন্ডে বাংলাদেশের হাফেজ আনাস বিন আতিক ৩০ পারা গ্রুপে প্রথম স্থান অর্জন করেন। পুরস্কার ২ লাখ রিয়াল যা বাংলাদেশের ৬৫ লাখ টাকা।
পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে রাজকীয় সৌদি সরকারের বাদশা সালমান বিন আব্দুল আজিজ আল সৌদ এর পক্ষ থেকে মক্কার ডেপুটি গভর্নর আল সাউদ বিন মিশাল বিন আব্দুল আজিজ আল সাউদ, রাজকীয় সৌদি সরকারের ধর্ম মন্ত্রী শেখ ডা. আবদুল লতিফ বিন আব্দুল আজিজ আল শেখ, কাবা শরীফের ইমাম ডা. আব্দুর রহমান আল সুদাইস, শেখ মাহের আল মুজেজাকলি, শেখ আব্দুল্লাহ আবাদ আল জোহানি, শেখ তাওসারি সহ সৌদি সরকারের ধর্ম মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন।
ঢাকার যাত্রাবাড়িতে অবস্থিত মারকাজুত তাহফিজ ইন্টারন্যাশনাল মাদ্রাসার ছাত্র হাফেজ আনাস বিন আতিক ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার লোপাড়া গ্রামের হাফেজ মাওলানা আতিকুর রহমানের ছেলে।
এইচএ